পুষ্টির ডিনামাইট সজনা’র যত গুনাগুণ

1036
পুষ্টির ডিনামাইট সজনা'র যত গুনাগুণ। প্রতিকী-ছবি

সুপ্রভাত বগুড়া (রান্না-বান্না): গ্রাম-বাংলায় সজনে একটি পরিচিত গাছ। সজনে গাছ বাড়ে দ্রুত। দুই থেকে তিন বছরে ফুল দেয়। এই গাছের ফুল, পাতা, ফল সব কিছুই সুস্বাদু। ইংরেজিতে সাজনার নাম ‘ড্রামস্টিক’ কিংবা Horse Radish Tree । বৈজ্ঞানিক নামঃ-Moring Oleifera Lam.সজনে গাছের পাতা ও সজনের বিষ্ময়কর উপকারিতা সম্পর্কে জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। আল্লাহর এই নেয়ামত সম্পর্কে সবার জানা দরকার। আমাদের সকলের পরিচিত এই গাছটির নেয়ামত সম্পর্কে, ৮০% লোকে জানেন না।

সাজনা গাছের মধ্যে হাজার হাজার ঔষধি গুণাগুন আছে, যা জানতে পারলে আমাদের সকলের উপকারে আসবে ইনশাল্লাহ। সাজনা, সাজনা গাছের পাতার – মাধ্যে আল্লাহ তালা ৩০০ রোগের ঔষধ দিয়াছেন, তার মধ্যে বর্তমানে ডায়বেটিস, গেঁজ বা ভগন্দর, আলসার এবং কেন্সার রোগের কোষ ধংস করার বড় গুন আছে।এই গাছটিকে মিরাকল ট্রি বা অলৌকিক গাছ নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এ গাছ মানব শরীরে যেমন হরমোন বর্ধন করতে পারে, তেমনি পারে মায়েদের বুকের দুধ বাড়িয়ে দিতে, সাজনার পাতার রস খেলে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি হয় ও আহারের রুচি বৃদ্ধি পায়। সাজনার মধ্যে আছে ভিটামিন এ, বি, সি, নিকোটিনিক এসিড, এমানো এসিড, প্রোটিন ও চর্বি, কার্বোহাইড্রেট, গ্লাইকোরোটিনিস ইত্যাদি উপাদান আছে।আমাদের দেশে সবজি হিসাবে ব্যবহৃত হলেও, সারা বিশ্বে সাজনা একটি অতি প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী উদ্ভিদ হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে।

এত উপকারি সাজনা পাতা দিয়ে ভারতীয়রা স্যুপ তৈরি করে পান করে থাকে। সাজনা আবার বসন্ত রোগও প্রতিরোধ করতে পারে। সর্দি কাশিতে, যকৃতের কার্যকারিতায়, কৃমি প্রতিরোধে ফলদায়ক। শরীরের ব্যথা নাশক, হজম শক্তি বর্ধক, রক্তের সংবহনতন্ত্রের ক্ষমতা বর্ধক, উচ্চ রক্তচাপ কমায়, রক্ত স্বল্পতা দূর করে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে, হাপানি রোগ নিরামক করে, বাত রোগও উপশম করে।

১০০ গ্রাম সজনে পাতার মধ্যে যে পুষ্টিগুণঃ                                                                             ১. দই এর চেয়ে ৯ গুন প্রটিন বেশি আছে।
২. গাজরের চেয়ে ১০ গুন বেশি ভিটামিন এ আছে।
৩. কলার চেয়ে ১৫ গুন বেশি পটাশিয়াম আছে।
৪. দুধ এর চেয়ে ১৭ গুন বেশি ক্যালসিয়াম আছে।
৫. কমলার চেয়ে ১২ গুন বেশি ভিটামিন সি আছে।
৬. পালং শাক থেকে ২৫ গুন বেশি আয়র্ন আছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বহু বছর ধরে বাড়ির আনাচে-কানাচে, বনে-জঙ্গলে, পুকুরের ধারে এই গাছ দেখা যায়।

সম্প্রতি সেনেগাল, মালির মতো আফ্রিকান দেশগুলোতে এর চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিক ভাবে। Moringo (মরিনগো) নামে শ্রীলঙ্কায় পরিচিত। তেল-রসুন দিয়ে রান্না সজনে খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। সজনে পাতা ও সজেনাতে আঁশ আছে, যা খাদ্যনালী ও অন্ত্রে পরিপাক তন্ত্রকে পরিষ্কার করে। বিশেষ করে তৈলাক্ত অনেক খাবার আমরা খাই, যার তেল রক্তনালীতে আটকে থাকে। এগুলো বের করতে সজনে সাহায্য করে।

সজনের মধ্যে আইসোথিয়োকাইনেটস নামে একটি উপাদান আছে, যা গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং গ্যাস্ট্রিক জনিত ক্যানসার ঠেকাতে সহায়তা করে। সজনেতে ছয়টি গুণ আছে-পুষ্টির ডিনামাইট: প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিনসি, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি এতে আয়রনও আছে। আয়রনের দিক থেকে এটি পালং শাকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি শক্তিশালী।

এন্টি-অক্সিডেন্টের খনি: সজনের পাতাকে এন্টি-অক্সিডেন্টের খনি বলা যায়। এর মধ্যে আছে ভিটামিন সি, বেটা-কেরোটিন, কিউরেকটিন এবং ক্লোরোজেনিকঅ্যাসিড। এসব উপাদান মানব দেহের জন্য উপকারী। সাধারণত, ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড রক্তের চাপ ও শর্করা কমাতে বিশেষ কাজে দেয়। এশিয়ান প্যাসিফিক জার্নাল অব ক্যানসার প্রিভেনশনদারি করছে, সজনের পাতায় বিদ্যমান এন্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসার কোষ সৃষ্টিতে বাধা দেয়।

ডায়েবেটিস: এন্টি-অক্সিডেন্ট এবং আইসোথিয়োকাইনেটস নামের উপাদানগুলো নিয়মিত গ্রহণে ডায়েবেটিস কমে যায়। প্রতিদিন মাত্র ৫০ গ্রাম সজনের পাতা খেলে ডায়বেটিস ২১ শতাংশ হ্রাস পায়। এক চা চামচ করে সজনে পাতার গুড়া খেয়ে ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

তেলেস মাতি: সজিনার বীজের তৈরি তেলে সত্যিই তেলেসমাতি আছে। অন্য যে কোনো ভেজিটেবেল অয়েল-এর চেয়ে এর গুণাগুণ বেশি। দীর্ঘ দিনের লিভারের রোগীর জন্য এ তেল খুব উপকারী। সজিনা গ্রহণে খাদ্যের গুণগত মান অটুট থাকে। পচনশীল খাবারকে দীর্ঘ স্থায়ীত্ব দিতে সজনের তেল খুব উপকারী। বাতের ব্যথা-বেদনায় এই তেল ব্যবহার করা যায় এবং শীতের আর্দ্রতা থেকে ত্বককে রক্ষা করা, রূপচর্চাতেও এই তেল কাজে লাগে।

কোলেস্টেরল: ঘাতক কোলেস্টেরলকে হত্যা করে সজনে হৃদপিণ্ডের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। থাইল্যান্ডে বহু বছর ধরে সজনেকে হৃদরোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ৩ মাসের ব্যবহারে এটি কোলেস্টেরল লেভেল অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারে।

আর্সেনিক দূষণ: একটি বৈশ্বিক সমস্যা আর্সেনিক দূষণ। এই সমস্যা নিরোধে সজনের বীজ কিংবা পাতা ভূমিকা রাখে। এমনকি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করতে সজনে বীজ বা পাতা ব্যবহার কার্যকরী।

দাঁতের মাড়ির সুরক্ষায়: অনেক সময় দাঁতের মাড়ির সমস্যায় ভুগে থাকেন অনেকে। দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া এবং মাড়ি ফুলে যাওয়া সমস্যায় ইদানীং অনেককে পড়তে দেখা যায়। এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে সজনে পাতা। সজনে পাতা ১/২ মগ পানিতে ফুটিয়ে নিয়ে সেই পানি দিয়ে ভালও করে প্রতিদিন কুলকুচা করতে হবে। এতে মাড়ির সকল সমস্যার সমাধান হয়।

হেঁচকি ওঠা উপশমে: হেঁচকি ওঠা যে কতো কষ্টের তা যারা ভুক্তভোগী তারা ঠিকই জানেন। একবার হেঁচকি উঠা শুরু করলে তা বন্ধ হতে চায় না সহজে। কিন্তু সজনে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে বেশ সহজে। সজনে পাতার রস ৯/১০ ফোঁটা আধ গ্লাস দুধের সাথে মিশিয়ে পান করে ফেলুন এক নিঃশ্বাসে। দেখবেন হেঁচকি ওঠা দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে।
লাল চায়ের কিছু অজানা উপকারিতা

বাতের ব্যথা উপশমে: বাতের ব্যথা উপশমে সজনে গাছের ছাল বেশ কার্যকর। এই পদ্ধতি বেশ প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। সজনে গাছের ছাল তুলে তা বেটে রস চিপে নিয়ে এই রস নিয়মিত প্রতিদিন ৪-৬ চা চামচ খেলে বাতের ব্যথা প্রায় ৬৫% উপশম হয়।

উচ্চ রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে: সজনে ডাঁটা খাওয়া উচ্চ রক্ত চাপের রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। সজনে দেহের কোলেস্টোরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া উচ্চ রক্ত চাপের চিকিৎসায় সজনের পাতাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সজনের পাতার (কচিনয়) রস প্রতিদিন নিয়ম করে ৪-৬ চা চামচ খেলে উচ্চ রক্ত চাপের সমস্যা অনেকাংশে কমে যায়।

পেটের সমস্যা সমাধানে: বহুকাল আগে থেকে সজনে হজমের সহায়ক খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পেটে গ্যাস হলে, বদহজম হলে এবং পেটে ব্যথা হলে সজনের তৈরি তরকারীর ঝোল খেয়ে নিন। দেখবেন পেটের গোলমাল অনেক উপশম হয়ে গিয়েছে।

টিউমার বা আঘাত জনিত ফোলা উপশমে: টিউমার যখন একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় থাকে তখন সজনের পাতা এই টিউমার নিরাময় করতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় টিউমার ধরা পরলে তাতে সজনে পাতা বেটে প্রলেপের মতো ব্যবহার করলে টিউমারের ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া ব্যথা বা আঘাত পেলে দেহের কোনো অংশ ফুলে উঠলে একই উপায়ে তা নিরাময় করা সম্ভব।

সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সজনে দানা পানি বিশুদ্ধ করণে সব চেয়ে ভালো প্রাকৃতিক উপায়। এক গবেষণা বলা হয়েছে, সজনের দানা পানি দূষণ রোধ করে, পানিতে কোনো রকম দূষণীয় ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো অণুজীব উপদান দ্রবীভূত হতে দেয় না। আমেরিকা, নামিবিয়া, ফ্রান্স ও বতসোয়ানার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সজিনার আণুবিক্ষণিক প্রোটিন উপাদান পানি বিশুদ্ধকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। একইভাবে সজনে শরীরকে বিশুদ্ধ রাখে। সজনেকে আজকের বিশ্বে ‘সুপার ফুড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

খাবার হিসেবে সজনে বা সজনে পাতাঃ সাজনা গাছের পাতা শাক হিসাহে অনেক জনপ্রিয়। যা মানব শরীরের জন্য অনেক প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে এই গাছের পাতার অনেক চাহিদা। আমার আশা এবং বিশ্বাস খুব তাড়াতাড়ি চা পাতার মত সাজনা পাতাও আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি হবে। সাজনা গাছের পাতা অবশ্যই খাওয়া যায়, অন্য শাকের মতই ভাজি করে খাওয়া যায়, সাধও অনেক ভালো।। অনেক হেসি/হেচি/পানি কলসের শাকের মত, খুব টেষ্টি।।

এছাড়াও সাজনার পাতা টেলে পেয়াজ কুচি রসুন , কাচা ঝাল হালকা তেলে হলুদ লবন দিয়ে ভেজে গরম ভাত দিয়ে খেয়ে দেখতে পারেন, এতে শরীরের পানি জমা বা গায়ে ব্যাথা কমে যাবে ইনশাল্লাহ। সাত থেকে আট দিন খেতে হবে যাদের শরীরে পানি যমে পা ফুলে খুব তাড়াতাড়ি ভালো হবে ।সাজনা গাছ লাগানো অনেক সহজ, সাজনা গাছের ডালা সমান ভাবে কেটে লাগিয়ে দিলে হয়ে যাবে। তাই আমার বিশ্বাস, আপনারা প্রতেকে একটি করে গাছ আপনার বাড়ি কিংবা রাস্তা ঘাটে লাগাতে পারেন।

সজনে ছালের ভর্তার রেসিপিঃ সাজনার ছালের বাইরের শক্ত আবরণ তুলে নিয়ে, ভালোভাবে ধোয়ে নিয়ে,শিলপাটায় সাজনার ছাল, কিছু পেয়াজ রসুন, কাঁচা মরিচ দিয়ে বেটে মিহি করে নিতে হবে, পরিমাণ মত লবণ মিশিয়ে দিলেই সাজনা ছালের ভর্তা হয়ে যায়। সরিষার মত ঘ্রাণ করে।ছাল সিদ্ধ করতে হবেনা।