আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ও ফাতেহা-ই ইয়াজদহম

আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ও ফাতেহা-ই ইয়াজদহম। প্রতিকী-ছবি

আলহাজ্ব হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুল হক

সুপ্রভাত বগুড়া (ধর্ম ও জীবন): শায়খ সাইয়েদ আব্দুল কাদের জিলানী আল হাসানী ওয়াল হুসাইনী (রহঃ) হলেন, হযরত আলী (রাঃ)-এর বংশধর। একদিকে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর পিতৃকুলে ছিল হযরত হাসান (রাঃ)-এর বংশধর, অপর দিকে মায়ের খান্দান ছিল হযরত হুসাইন (রাঃ)-এর উত্তরসূরী। বড়পীর খ্যাত এই বিখ্যাত মনীষীর পিতার নাম হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গিদোস্ত ইবনে আবু আব্দুল্লাহ (রহঃ)।

খোদভীরু এই মুজাহিদ বিনা অনুমতিতে একটি ফল খাওয়ার অনুশোচনায়, মালিককে খুঁজে বরে করে ক্ষমা প্রার্থনা করা অতঃপর ক্ষমার শর্ত হিসেবে মালিকের বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করার ঘটনা এক কথায় অবিশ্বাস্য। হযরত জিলানী (রহঃ)-এর মাতার নাম উম্মুল খায়ের ফাতেমা বিনতে আব্দুল্লাহ সাইমেয়ী (রহঃ)। তিনিও একজন উঁচ্চস্তরের দীনদার মহিলা ছিলেন। বড়পীর (রহঃ) তৎকালীন পারস্য দেশের তাবারিস্তানের জিলান শহরে ১লা রমজান ৪৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।

Pop Ads

হযরত জিলানী (রহঃ) অল্প বয়সেই সেকালের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে সুপরিচিত বাগদাদ শহরের নিজামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সকলকে অবাক করে প্রথম সবকেই কুরআন মাজিদের ১৮পারা হিফজ (মুখাস্ত) উস্তাদকে শুনান বলে জনশ্রæতি রয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত তী² মেধায় তিনি ১৩টি বিষয়ের উপর পান্ডিত্য অর্জন করেন। জাহেরী ইলমের পাশাপাশি বাতেনী ইলমেও মনোনিবেশ করেন। তিনি এমন সব কিতাবাদি প্রণয়ন করেছেন যা হেদায়েতের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে। বিশেষ করে ফাতহুল গুয়ুব, সিররুল আসরার, ফাতহুর রাব্বানী, কাসীদাতুল গাউসিয়া, গুনিয়াতুত তালেবীন উল্লেখযোগ্য।

তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদা পোষণ করতেন। ইসলাম ধর্মে আধ্যাতিক সাধনার ক্ষেত্রে উঁচ্চস্তরের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তাকে বড়পীর বলা হয়। তিনি মহিউদ্দীন, গাউসুল আজম, গাউসে পাক, পীরানে পীর দস্তগীর, মাহবুবে সুবহানী, ওলীকুল শিরোমনি প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হন। হযরত জিলানী (রহঃ) বাগদাদের মহানপীর হযরত আবু সাইদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন মাখরুমি (রহঃ)-এর কাছে মারেফাতের জ্ঞানে পূর্ণতা লাভ করেন এবং খেলাফতপ্রাপ্ত হন। তিনি প্রশিদ্ধ চার তরিকার অন্যতম কাদেরিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা। সূফীবাদের প্রধান প্রচারক হিসেবে সুবিদিত এই মহান বুজুর্গ আজীবন ইসলাম প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

বিভিন্ন ওয়াজ-নসীহতে ইসলামের সুমহান আদর্শ যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উপস্থাপন করতেন। আত্মশুদ্ধি আত্মউন্নতির জন্য উপদেশ দিতেন। তার মাহফিলে শুধু মসলমান নয় বরং অনেক অমুসলিমও অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর আবেগী ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য শুনে অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তরিকতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের অনেক কারামত প্রকাশ পেয়েছে। তবে কিছু ভক্ত এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে থাকেন। তাসাউফের শ্রেষ্ঠ সাধক জিলানী (রহঃ) ১১ই রবিউস সানী ৫৬১হিজরী সোমবার সকালে ইন্তেকাল করেন। শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) তাকে গোছল দেন এবং কাফন পরিধান করান।

রাতে তাকে কবরস্ত করা হয়। তাঁর মাজারের ঠিকানা, শায়খ আব্দুল কাদের জিলানীর দরগা, বাগদাদ, ইরাক। ইসলামী খেদমতে তাঁর অবদান পুরো বিশ্বে অনন্য। বড়পীর (রহঃ)-এর মৃত্যুতে শোকময় স্মৃতিকে অন্তরে পুনঃজাগ্রত করার উদ্দেশ্যে প্রতি চন্দ্র মাসের দশম দিনের দিবাগত রাতে তাঁর ভক্তকুল গেয়ারভী শরীফ বা ১১ই শরীফ পালন করে থাকেন। ফাতেহা-ই ইয়াজদহমঃ ‘ফাতেহা’ বলতে বুঝানো হয় কোনো মাইয়েতের জন্য দুআ করা। ‘ইয়াজদহম’ ফার্সী শব্দটির অর্থ এগারো। ১১৮২খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ৫৬১হিজরী ১১ই রবিউস সানী তারিখে বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ইন্তেকাল করেন।

তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে উক্ত তারিখে যে মৃত্যুবার্ষিকী পালন, উরস ও ফাতেহাখানী করা হয় তাকে ফাতেহা-ই ইয়াজদহম বলে। এখন আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, ইসলামে এধরনের অনুষ্ঠানসর্বস্ব ফাতেহ-ই ইয়াজদহম ও গেয়ারভী শরীফ পালনের স্বীকৃতি দেয় কি না? জিলানী (রহঃ)-এর ওফাত উপলক্ষে নির্দিষ্ট তারিখে ঘটা করে দিবসটি পালন করাকে হক্কানী উলামায়ে কেরাম জায়েজ মনে করেন না। কেননা ইসলামে জন্মবার্ষিকী বা মৃত্যুবার্ষিকী পালনের নিয়ম রাখা হয়নি। যদি থাকতো তবে বছরের প্রতিটি দিনই জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালন করতেই ধর্ম-কর্ম শেষ হয়ে যেত।

কারণ সারা বিশ্বে প্রত্যেক দিনই কোনো না কোনো মহান ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ), সাহাবা ও তাবেয়ীনের যুগে তথা আদর্শ যুগে জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, উরস ইত্যাদি পালন করা হতো না। এগুলো পরবর্তীতে সৃষ্টি। অতএব ইসলামের নামে এসব অনুষ্ঠান রুসম ও শরীয়ত বিবর্জিত বিদআত হবে। তবে হযরত জিলানী (রহঃ) শ্রেষ্ঠতম একজন ওলী ছিলেন। বিধায় এই নির্দিষ্ট তারিখের অনুসরণ না করে যেকোনো দিন যেকোনো সময় তাঁর জন্য দুআ ও ঈসালে সাওয়াব করলে তাঁর রুহানী ফায়েজ-বরকত লাভের ওসীলা হবে এবং নিঃসন্দেহে তা সওয়াবের কাজ হবে।