একুশঃ ভাষা থেকে স্বাধিনতা

একুশঃ ভাষা থেকে স্বাধিনতা- মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

বাঙালির সভ্যতার ভিত একুশের শহিদের আত্মদানের ওপর। বাঙালির মেরুদন্ড মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাঙালিরা ছিল সোচ্চার। ১৯৫২-এর সূর্যসন্তানদের রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের গৌরবগাঁথা। রক্তেরাঙা ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি তাজারক্তে মাতৃভাষা বাংলা’র অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, ছয় বছর বয়সের মধ্যেই শিশুর মাতৃভাষায় কথা বলার দক্ষতা ১০০ ভাগ অর্জিত হয়। মাতৃভাষা শিক্ষার বিষয়টি সব সময় প্রাকৃতিক ও স্বয়ংক্রিয়।

এর জন্য কোনো শিক্ষক বা আলাদা কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন হয় না। আজ বিশ্বের বুকে মাতৃভাষা বাংলা গৌরবময় আসনে আসীন। শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা স্থাপনে একটি জাতির প্রচেষ্টা এবং আত্মোৎসর্গ দুনিয়ার অন্য কোন জাতির ইতিহাসে নাই।

Pop Ads

মানুষের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন, রাষ্ট্রজীবন ও জাতীয় জীবনের বিকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে। ভাষা মানুষের বেঁচে থাকার হাতিয়ার। ২১ফেব্রুয়ারি এ দেশের মানুষকে শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান। স্বদেশ প্রেম জন্মভূমির জন্য মানুষের এক ধরনের অনুরাগপূর্ণ ভাবাবেগ। ভাষা মানুষের বেঁচে থাকার হাতিয়ার। এককথায় স্বদেশ প্রেম বলতে বোঝায় নিজের জন্মভূমিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা। জাতি হিসেবে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সমন্বয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেছি।

মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে মহত্তর স্বাধীনতার চেতনা। পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত এই রাষ্ট্রে সমতা ও ন্যায় নেই; পরিবর্তে আমাদের বাঙালিদের জন্য আছে সীমাহীন শোষণ, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও অপমান। সর্বোপরি সব ক্ষেত্রে এক উৎকট বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠল। জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব ও ভাগ্যকে জুড়ে দেয়া হয়েছিল কৃত্রিম ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার ফলে বাংলার মানুষ মূলত আবার বন্দী হলো পাকিস্তানি দুঃশাসনের জাঁতাকলে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানিরা প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর।

সে সময় পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা ৭ জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাংলা ভাষার দাবি ছিল সাত কোটি বাঙালির প্রাণের দাবি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা বাঙালির ন্যায্য দাবিকে পদদলিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা এম.এ. জিন্নাহ সাহেব। ঠিক তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলার সূর্যসন্তানরা।

ভাষার প্রতি বাঙালির চিরঞ্জীব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে ক্রমান্বয়ে জোরালো হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি। ভাষা আন্দোলন এই বৈষম্য ও অপমানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম সরব জবাব।

আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদার দাবি, স্বাধিকার সংগ্রাম ও আর্থ-সামাজিক অর্জনের ভিত্তি মহান একুশ। বাংলাভাষা আমাদের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা ও মানবাধিকার অর্জন, আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা। দেশপ্রেমের ফলে মানুষের মন মহৎ ও উদার হয়। মনের ভেতর স্বদেশের জন্য ভালো কাজ করার উৎসাহ পায়। দেশপ্রেমের মহিমার ফলে জাগ্রত হয় অপরের জন্য কল্যাণ। বড় হয়ে মানুষ অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য হলেও জন্মভূমির মায়া কখনো ভুলতে পারে না।

জন্মভূমির প্রতি, শৈশবের লীলাভূমির প্রতি মানুষের এ সীমাহীন আকর্ষণ ও অকৃত্রিম ভালোবাসাকেই বলে স্বদেশ প্রেম। স্বদেশের মাটি, আলো-বাতাস, আবহাওয়া, আকাশ, ঋতুবৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনকে সদা উৎফুল্ল­ করে ও আচ্ছন্ন রাখে। জন্মভূমির শ্যামল মাটি, সবুজ বনানী ও অন্নজলের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ অপরিসীম ও চিরন্তন। স্বদেশকে ভালোবেসে যুগে যুগে অনেক বীর যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। বিশ্ব জানছে, বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্যে যুদ্ধ করেছে।

বাংলার ভাষা তেমনি প্রেম এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। তাই বাংলার ভাষার শহীদদেরও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মানুষ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর প্যারিসে তার ৩০তম সাধারণ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে সর্বসম্মতিক্রমে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারপর থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশের ৬০০ কোটিরও অধিক মানুষ প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। বিশ্ববাসীর একধরনের সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।

একুশ শতকের সূচনা প্রান্তে এসে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো মাতৃভাষাগুলো অধিকার এবং মর্যাদার টিকিয়ে রাখার জন্য যে-সাধারণ সংগ্রামের সূচনা করে, তা সারা বিশ্বের ভাষা প্রবাহে অসামান্য অবদান রাখছে। একইসাথে এ দিন বিশ্বের বৃহৎ ভাষাগুলোর পাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবহেলিত ভাষাগুলোও বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাচ্ছে। কাল থেকে কালান্তরে মাতৃভাষার প্রতি বাঙালি জাতির দায়িত্ব শতগুণে বেড়ে যায়।

ভাষা দিবস একুশ ফেব্রুয়ারি ও বাংলা ভাষার কদর সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর আমাদের ইতিহাসের একটি রক্ত-রঙিন দিন নয়, এ দিন এখন পেয়েছে বিশ্বস্বীকৃতি। ভাষায় মানুষের বিচ্ছিন্নতা দূর করে, পরস্পরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে শিখিয়েছে। ভাষা শ্রেণি মানে না, ধর্ম মানে না, আঞ্চলিক বিভেদকে অগ্রাহ্য করে। কাজেই দেশ ও জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বাংলাভাষা চর্চাকে বিকশিত ও উন্নত করাই হবে আমাদের অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক: প্রাবন্ধিক