করোনার প্রভাব: বছরজুড়ে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ঝরেপড়া বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রমের আশংকা

করোনার প্রভাব: বছরজুড়ে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ঝরেপড়া বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রমের আশংকা। প্রতিকী-ছবি

সুপ্রভাত বগুড়া (স্বাথীন মতামত): করোনা ভাইরাস সংক্রমণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাল্যবিয়ের হার ও শিশুশ্রম বেড়ে যেতে পারে। প্রায় ১০ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খুলবে, কেউ জানে না। করোনা ভাইারাস সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ধরে রাখা সরকারের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রচলিত পাঠদান বন্ধে গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার্থীরা।

বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে, গ্রামের বেশিরভাগই এ সুবিধার বাইরে। সরকার টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস সম্প্রচার করছে, সেখানেও উপস্থিতি ভালো নয়। এ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও সমমানের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষাও হচ্ছে না। বাতিল হয়েছে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা এবং এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষাও। একের পর এক পরীক্ষা বাতিল আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনার রুটিনে ছন্দপতন, লেখাপড়ায় অমনোযোগী এবং পরিবারের আর্থিক সংকটে বাড়বে ঝরেপড়া।

Pop Ads

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদ কে চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও বড় ধরনের আঘাত এসেছে। টেলিভিশন, অনলাইন, বেতার ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরকার পড়াশোনা চালু রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এসব প্রক্রিয়া চালু রাখার পরও সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যায়নি। কীভাবে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে সব উন্নয়নশীল দেশই হিমশিম খাচ্ছে। এটি আমাদের জন্যও বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমাদের এখানে মূল্যায়ন হয় শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় এবং জাতীয় কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু করোনার কারণে সব থমকে গেছে।

তিনি বলেন, দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়বে শিক্ষার্থীদের একটা অংশ। তাদের কীভাবে ধরে রাখা যাবে, এটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অনলাইন বা টেলিভিশনে প্রচারিত শিক্ষার কোনো মাধ্যমেই যুক্ত হতে পারেনি। যখন পরিবেশ অনুকূল হবে, তখন বিদ্যালয় খুললে সব শিক্ষার্থীকে ফেরত পাওয়া যাবে কিনা, এটি একটি বড় প্রশ্ন। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনা ও তাদের সহায়তার জন্য তহবিল থাকতে হবে। সে জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে প্রণোদনা প্যাকেজ দরকার। একই সঙ্গে এর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সে জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, করোনার পর ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্কুলে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকবে না। যাদের খাবারের অভাব তাদের শ্রম দিতে বাধ্য করবে। কারণ চলমান মহামারীর ফলে অনেক গরিব পরিবার আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়বে, সে ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে পাঠাতে চাইবে। এই ৩০ শতাংশ যারা ঝরে পড়তে পারে, তাদের একটা ডাটাবেস সরকারিভাবে এখনই করা দরকার। এ তালিকা শিক্ষকদের দিয়ে করতে হবে।

দেশের দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য মাসে ৩০০-৪০০ টাকা বৃত্তি ও এক বেলা করে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, ঝরে পড়ার একটি কারণ দারিদ্র্য। এ জন্য প্রাথমিকের শিশুদের জন্য বৃত্তি, উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। দুপুরে স্কুলেই এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা (স্কুল ফিডিং) করা হচ্ছে। এতে ঝরে পড়ার হার অনেকাংশেই কমে যাবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমিয়ে আনতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষা বৃত্তি ও স্কুল ফিডিং কর্মসূচি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। আমরা শিক্ষায় একটি বড় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। কারিকুলামে বড় পরিবর্তন আসছে। আমরা শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে চাই। এ জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাধ্যমিক স্তরেও কারিগরি শিক্ষা যুক্ত করা হচ্ছে। এতে পড়ালেখার পাশাপাশি হাতে-কলমে কাজ শিখতে পারবে শিক্ষার্থীরা। তাদের মাধ্যমিক শিক্ষা শেষেও চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। ফলে ঝরে পড়া অনেকাংশেই কমে যাবে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকে ২০১৯ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৯ সালে এই হার ছিল ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ। এর পর থেকে পাঁচ বছর নানা উদ্যোগের ফলে ব্যাপকভাবে ঝরে পড়া কমেছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ঝরে পড়ার হার প্রায় একই।

মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৪০ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৪১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ২০০৯ সালে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৫৫ দশমিক ৩১। এর পরের পাঁচ বছর দ্রুতগতিতে ঝরে পড়ার হার কমলেও গত পাঁচ বছরে তা ঝিমিয়ে পড়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২০ দশমিক ০৮ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০০৯ সালে ছিল ৪২ দশমিক ১১ শতাংশ।