দেশে বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি

দেশে বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি

বাংলাদেশে বন্যার ঝুঁকি অতীতের তুলনায় অনেক বেড়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আর্থ অবজারভেটরি। এর মধ্যে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি তুলনা করে নাসা দেখিয়েছে, রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে থাকা বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগের মতো নদীগুলো এবং সবুজ এলাকা জনবসতির চাপে কীভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ থেকে দুই কোটির বেশি হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই বাংলাদেশের রাজধানীকে নিয়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের তালিকায়। এর মানে আরও অনেক মানুষ এখন ঢাকার বন্যাপ্রবণ এলাকায় বাস করে।

Pop Ads

প্রতিবেদনে শহরের বৃদ্ধি দেখাতে স্যাটেলাইট ল্যান্ডস্যাট ৫ ও ৮ থেকে তোলা ঢাকার দুই সময়ের দুটি ছবি তুলে ধরা হয়। প্রথম ছবিটি ১৯৮৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ধারণ করে ল্যান্ডস্যাট-৫ এর থিমেটিক ম্যাপার। একই এলাকার আরেকটি ছবি গত ২০ মার্চ ধারণ করে ল্যান্ডস্যাট-৮ এর অপারেশনাল ল্যান্ড ইমেজার (ওএলআই)। এমনিতে ঢাকা শহর নদী ও উপনদী দ্বারা বেষ্টিত।

এর দক্ষিণে রয়েছে বুড়িগঙ্গা, পশ্চিমে তুরাগ, উত্তরে টঙ্গী খাল এবং পূর্বে বালু নদী। ঢাকার জনসংখ্যার একটি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, ২০০০ সাল থেকে বুড়িগঙ্গা এবং বালু নদীর আশপাশে জনবসতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার পেন স্টেট, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি দল সম্প্রতি বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ট্র্যাক করতে রাতের আলো এবং ভূমির ব্যবহারের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছে। ২০২২ সালের জুন মাসে তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭ কোটি মানুষ বন্যাপ্রবণ এলাকায় (কোন নদীর দুই কিলোমিটারের মধ্যে) বাস করে, যা ২০০০ সালের তুলনায় প্রায় ১৫ লাখ বেশি।

বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৬০ লাখ মানুষ বন্যাঝুঁকি আছে এমন অঞ্চলে বাস করে। এই বিশ্লেষণে গবেষকরা মার্কিন প্রতিরক্ষা আবহাওয়া স্যাটেলাইট প্রোগ্রামের অপারেশনাল লাইনস্ক্যান সিস্টেম (ওএলএস) এবং সুওমি-এনপিপি স্যাটেলাইটের ভিজিবল ইনফ্রারেড ইমেজিং রেডিওমিটার স্যুট (ভিআইআইআরএস) প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরসহ সারাদেশে প্লাবনভূমিতে রাতের আলো বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে আলো বেড়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট এবং ময়মনসিংহ শহর ও এর আশপাশে। গবেষণাটির সহ-লেখক পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূগোলবিদ আরিফ মাসরুর বলেন, বাংলাদেশে নদীর ২ কিলোমিটারের মধ্যে রাতের আলো বেড়েছে ২৩৫ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জমির অভাব মানুষকে প্লাবনভূমিতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও বসতি গড়ে তুলতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। আরও মানুষ ধান বা মাছ চাষ করতে বা বসবাসের জন্য প্লাবনভূমিতে চলে যাচ্ছে।

গবেষণার আরেক সহ-লেখক কার্টিন ইউনিভার্সিটির ভূগোলবিদ আশরাফ দেওয়ান বলেন, প্লাবনভূমিগুলোয় স্যাটেলাইট ছবিতে রাতের যে আলোকসজ্জা চোখে পড়ে সেই তথ্যের চেয়েও সেখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষের বেশি হতে পারে। এটা অনুমান করা যেতে পারে যে, নদীর দুই কিলোমিটারের মধ্যে বাস করা অনেক পরিবার বৈদ্যুতিক সংযোগের বাইরে আছে। যদিও ওএলএস এবং ভিআইআইআরএস নির্ভরযোগ্যভাবেই গ্রামগুলোকে শনাক্ত করতে পারে। তবে এর সেন্সরগুলো সবসময় যেসব পরিবার অর্থ সাশ্রয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বা প্রচুর গাছপালা রয়েছে- এমন এলাকার বাড়িগুলো শনাক্ত করতে পারে না।

ঢাকার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আশরাফ দেওয়ান জানান, রাজধানীতে ১৯৮৮ সালের বন্যায় মারাত্মক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল। ওই বন্যায় শহরে প্রাণ হারিয়েছিল দুই সহশ্রাধিক মানুষ। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় আরেকটি বিপর্যয়কর বন্যায় ৯০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং ক্ষতি হয়েছিল ৩০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ। এখন শহরের কিছু নিচু অংশে ও খালগুলোর পাশে জনবসতি বেড়েছে, যা বর্ষা মৌসুমের বন্যার ক্ষতির ঝুঁকিকে বাড়িয়েছে তীব্রভাবে।

যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে কড়াইল বস্তি, যা গড়ে উঠেছে লেকের ওপর। এই বস্তির বাড়িগুলো স্টিলের ওপর তৈরি করা হয় এবং ভারী বৃষ্টির হলে এ এলাকা প্লাবিত হয় নিয়মিত। আমরা আশা করি এই গবেষণা নীতিনির্ধারকদের জন্য সমস্যাটির মাত্রা পরিষ্কার করবে। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তা হলে বন্যায় আরও বাড়িঘর ধ্বংস এবং প্রাণহানি বাড়বে।