নৈতিক শিক্ষার তাৎপর্য-দর্শন

আলহাজ্ব হাফেজ মাওঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক

সুপ্রভাত বগুড়া (ধর্ম ও জীবন): মানুষ সমাজিক জীব হিসেবে নীতি-নৈতিকতায় বিশ্বাসী এক সভ্যপ্রাণী। মানুষ যখন নীতিবান না হয়ে স্বার্থন্বেষী ও আত্মকেন্দ্রিক হয় তখন সে হয় অসভ্য ও ঘৃণিত। সৎ ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্য নৈতিক শিক্ষা অপরিহার্য। যার মধ্যে নৈতিক শিক্ষার গুণাবলী রয়েছে তিনিই সত্যিকারের মানুষ। নৈতিকতা না থাকলে মানুষ মানসিক রোগীতে পরিণত হন। ফলে ভালো-মন্দ, হালাল-হারামের কোন পরওয়া করেন না। পক্ষান্তরে নৈতিক শিক্ষা মানুষকে পরিশ্রমি, বাস্তববাদী চরিত্রবান হতে অনুপ্রাণিত করে। অথচ আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে।

জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ভাবে পরিচালিত করতে নৈতিক শিক্ষা অতি জরুরি। কিন্তু দিন দিন নৈতিকহীনতা ও অশ্লিলতা স্বাভাবিকতা পাচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক বিষয়। অনৈতিকতা এবং অশ্লিলতা মুক্ত পরিবেশ গড়তে একসাথে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা মানুষকে বিকাশিত করে। শিক্ষা ছাড়া আত্মনির্ভরশীল দক্ষ ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি গঠন আসম্ভব। আর নৈতিক শিক্ষাই হলো আসল শিক্ষা, সুশিক্ষা যা মূল্যবোধের কারিগর। নৈতিকতা পাশবিক শক্তিকে পরাজিত করে মানুষকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে অধিষ্ঠিত করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় যারা কাফের, হোক তারা কিতাবধারী ও মুশরিক, তারা জাহান্নামের আগুনে চিরকাল দগ্ধ হতে থাকবে। তারাই সৃষ্টির নিকৃষ্ট।

Pop Ads

আর যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা। (সূরাঃ বাইয়িনাহ, আয়াতঃ ৬-৭) আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দোষ-গুণে সৃষ্টি করেছেন। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘অতঃপর তাতে ঢেলে দিলেন অপরাধপ্রবণতা ও তাকওয়া। অবশ্যই সে সফলকাম, যে নিজেকে শুদ্ধ করে। আর যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ, মনোরথ হয়। (সূরাঃ শামস, আয়াতঃ ৮-১০) প্রকৃত পক্ষে মানুষের চালিকা শক্তি হলো আত্মা বা কলব। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মাকে ঠিক রাখলে মানুষ সঠিক পথে পরিচালিত হয়।

পক্ষান্তরে আত্মশুদ্ধি না করলে আত্মা মানুষকে সঠিক ও সুন্দর পথে পরিচালনা করে না, বরং অন্যায় পাপাচার ও অপরাধে লিপ্ত করে। তাসাউফের পরিভাষায় আত্মা বা মনের হালত ২ প্রকার।

(১) মাহমুদ। দিলের ভালো হালতকে মাহমুদ বলে। আবার মুনজিয়াত বা ফাজায়েলও বলা হয়। আর ভালো হালত অর্জন করার নাম তাহলিয়া।

(২) মাজমুম। দিলের মন্দ হালতকে মাজমুম বলে। আবার মুহলিকাত বা রাজায়েলও বলা হয়। মন্দ হালত বর্জন করার নাম তাখলিয়া।

এখন জানবো কয়েকটি আত্মিক গুণ ও দোষ। আত্মিক ভালো গুণ হচ্ছেঃ

(১) ইখলাসঃ প্রতিটি নেক কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা, এটাকে সহীহ নিয়তও বলে।

(২) তাকওয়াঃ সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ইবাদত করা এবং গোনাহ থেকে বিরত থাকা।

(৩) সবরঃ বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করা। ইবাদতে পাবন্দি করা এবং গোনাহ বর্জন করার মাধ্যমে ধৈর্যধারণ করা।

(৪) তাওবাঃ গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, ক্ষমা চাওয়া।

(৫) তাওয়াক্কুলঃ আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হওয়া।

(৬) তাসলিমঃ আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বিনা প্রতিবাদে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া।

(৭) রজাঃ আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত, জান্নাত এবং অনুগ্রহ লাভের আশা রাখা।

(৮) মুহাব্বতঃ আল্লাহর মুহাব্বত-সন্তুষ্টিকে অন্য সকলের উপর প্রধান্য দেওয়া।

(৯) যুহদঃ দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত আশা পরিহার করা।

(১০) মুরাকাবাঃ আল্লাহর ধ্যান-খিয়াল করা।

(১১) মুহাসাবাঃ নিজ আমলের উন্নতি-অবনতির হিসাব করা।

(১২) কানায়াতঃ অল্পে তুষ্ট থাকা।

(১৩) গায়রতঃ আত্মমর্যাদা বোধ থাকা।

(১৪) রেজাঃ আল্লাহর সকল ফয়সালা-ইচ্ছার উপর রাজি হওয়া।

(১৫) অরাঃ সন্দেহজনক সমস্ত কাজ-কর্ম ও খাদ্য পরিত্যাগ করা। এখন জানবো মনের কয়েকটি রোগ সম্পর্কে।

দিলের রজায়েলগুলো হচ্ছেঃ

(১) তাকাব্বুরঃ অহংকার, নিজেকে বড় এবং অন্যকে ছোট মনে করা।

(২) হাসাদঃ হিংসা, পরশ্রীকাতরতা।

(৩) গিবতঃ কুৎসা রটানো বা পরনিন্দা করা।

(৪) কিজবঃ মিথ্যা বলা।

(৫) হিরসঃ লোভ-লালসা।

(৬) রিয়াঃ লোক দেখানো মনোভাব।

(৭) উজবঃ অহমিকা, আত্মগর্ব।

(৮) হুব্বে জাহঃ প্রশংসা, সুখ্যাতি, সুনাম ও সম্মানের লোভ।

(৯) হুব্বে মালঃ ধন-সম্পদের লোভ।

(১০) বুগজঃ কারো সাথে অন্তরে শত্রুতাভাব পোষণ করা।

(১১) বুখলঃ কৃপণতা।

(১২) গুরুরঃ ধোকা।

(১৩) কাসরাতে কালামঃ অধিক কথা বলার আগ্রহ।

(১৪) বানাওটঃ কৃত্রিমতা।

(১৫) বদগোমানীঃ কুধারণা।

(সূত্রঃ ইলমুত তাজকিয়া) যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের চারিত্রিক অবস্থা ভিতর থেকে পরিশুদ্ধ না হবে এবং নৈতিক শিক্ষা না থাকবে ততক্ষণ মানুষকে আইন, অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে অন্যায় কাজ থেকে পুরোপুরি বিরত রাখা অসম্ভব। একথা সর্বজনবিদিত। আল্লাহ আমাদের আত্মিক ও মানবিক উন্নতির জন্য উপরোক্ত ভালো গুন অর্জন ও মন্দ স্বভাব বর্জন করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)