বগুড়ায় শত শত মানুষকে ঠকিয়ে কোটি  টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও প্রতারক চক্র

বগুড়ায় শত শত মানুষকে ঠকিয়ে কোটি  টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও প্রতারক চক্র

শাফায়াত সজল: বগুড়া শহরের উপকন্ঠে একটি অভিজাত হোটেলে চলছে তরুন যুবকদের নিয়ে একটি সেমিনার। আর সেমিনারের আয়োজন করেছেন যারা তারাও যুবক। সেমিনারের আলোচ্য বিষয় হলো কিভাবে অতি কম সময়ে কম টাকা যোগান দিয়ে প্রতিদিন অনলাইনে ইনকাম করতে পারবেন ঘরে বসেই। আর সেজন্য কি কি করতে হবে সব নিয়ম কানুন শেখানো হচ্ছিলো এই সেমিনারেই।

আরো কিছু নিয়ম কানুন রপ্ত করে দেন প্রশিক্ষকেরা। এ যেন কোটি টাকার মালিক হবার অবাস্তব স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ নেওয়ার মতো গল্প। প্রায় ২ মাস আগে বগুড়া শহরের উপকন্ঠের একটি অভিজাত মোটেলে এমনই এক সেমিনারের আয়োজন করেছিলো এই প্রতারক চক্রটি। কিন্তু তারা তার আগে থেকেই শুরু করেছিলো লোক ঠকানো এবং প্রতারণা করা।

Pop Ads

প্রধানত এই প্রতারক চক্রটির প্রধান টার্গেট ছিলো বেকার যুবক, তরুণ, যুবতী, যারা স্কুল কলেজ পড়ুয়া।এছাড়াও কিছু মধ্যবয়সী ব্যক্তিও তাদের লক্ষ্য ছিলো। এরমধ্য আছে অসংখ্য শিক্ষিত যুবকেরাও। তারা সবাই এই আধুনিক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ মুখ ফুটে এই কথা শিকার করলেও কেউবা আবার লজ্জায় সংকোচে মুখ ফুটে প্রতারিত হওয়ার কথা বলতে পারছেনা।

অনেকেই নিজের জমানো টাকা প্রতারকদের হাতে তুলে দিয়েছেন ভরসায়, আবার কেউ কিস্তিতে টাকা তুলে সেই টাকা তুলে দিয়েছেন চক্রটির হাতে। এখন তারা সবাই প্রতারিত হয়ে হতাশ, নিরুপায় হয়ে পড়েছে। তাদের এখন কি করা উচিৎ, কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত এমন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তারা। দেনার দায়ে অনেকে এখন ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকেই আবার তাদের এই প্রতারিত হওয়ার কথা বাড়ির অভিভাবকদের সাথে ভয়ে কিংবা লজ্জায় মুখ ফুটে বলতেও পারছেন না।

রাশেদুল রাশেদ (ছদ্মনাম)। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন ৩য় শ্রেনীর কর্মচারী পদে। সে তার বেতনের টাকার একাংশ জমিয়ে সেই ৭৫ হাজার টাকা সরল বিশ্বাস এবং মিথ্যা প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে তুলে দিয়েছেন বগুড়া সদরের নিশিন্দারা ইউনিয়নের চাঁদপুর সোনারপাড়া গ্রামের আবু জাফরের সন্তান জিহাদ নামের এক প্রতারকের হাতে৷ এলাকায় ভাল ছেলে নামে পরিচিত মানুষরুপী এই জিহাদই প্রায় শতাধিক ব্যক্তির লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।প্রথমদিকে লোভকে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাশেদ লভ্যাংশ পেতে থাকে।

তার দেখাদেখি রাশেদের নিকট বন্ধুরাও অই প্রতারকের হাতে তুলে দেয় প্রায় লক্ষাধিক টাকা। খুলে নেয় একটি একাউন্ট। যার মাধ্যমে টাকা আসে বলে কথিত আছে। প্রথম দিকে সব গ্রাহকই তাদের লভ্যাংশ পেতে থাকে। তাই তারা অল্প সময়ে বড়লোক হবার বাসনা নিয়ে বেশি বেশি টাকা ইনভেস্ট করতে থাকে। আর এতেই প্রতারক চক্রটির উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য সফল হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেই।

সাইফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। পেশায় একটি বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন সহকারী শিক্ষক। মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করা এই যুবকটিও তার বেতন থেকে ১০ হাজার টাকা সরল মনে তুলে দেন প্রতারক চক্রের আরেক সদস্যের হাতে। তারপর তিনিও কিছুদিন লভ্যাংশ পেতে থাকেন। বিনা পরিশ্রমে এমন লভ্যাংশ পাওয়ায় তার মধ্যেও এক ধরনের লোভ কাজ করতে থাকে। তিনি বেতনের সম্পুর্ন জমানো টাকা যেটি মোটর সাইকেল ক্রয় করার জন্য রেখেছিলেন সেই টাকাটিই তুলে দিতে যাচ্ছিলেন চক্রটির হাতে।

কিন্তু তার আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এমন কর্মকাণ্ডটি। অল্পের জন্য বড়ধরনের ক্ষতি থেকে বেচে যান তিনি। তার মতে, তারই পরিচিত এক ছাত্র তাকে এমন অফার দেয় এবং সে তা গ্রহণ করে ইনভেস্ট করে। তার জানা মতে প্রায় ৪/৫ জন তরুণ আছে যারা দেড় লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে প্রতারকদের হাতে। কেউবা তুলেছে কিস্তি। এমন ভয়ংকর তথ্য দেন এই ভুক্তভোগী শিক্ষক। তিনি আশাবাদী, অপরাধীদের চিহ্নিত করে অতি দ্রুত গ্রেফতার করবে পুলিশ।

তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো প্রতারক চক্রটির প্রত্যেক সদস্যদের বয়স ২০ থেকে ৩০ এর মধ্য। তারা অনেকেই প্রায় কলেজপড়ুয়া। অপরদিকে যারা ভুক্তভোগী তাদের অনেকেই শিক্ষার্থী এবং তাদের বয়সও ১৮ থেকে ৩০ এর মধ্য। অরোরা নামক এই গ্রুপে যোগান দেওয়া ভুক্তভোগীরা একটি আলাদা গ্রুপ খুলেছে। যেখানে শুধু এই অভিনব প্রতারণার শিকার শতাধিক ব্যক্তিরা রয়েছেন। তাদের কেউবা দিয়েছেন ৩০ হাজার, কারো ৫৬ হাজার, আবার কারো ১২ হাজার। ধারণা করা হচ্ছে এই প্রতারক চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষদের ফাঁদে ফেলে।

এরমধ্যে বগুড়া সদর উপজেলার নিশিন্দারা ইউনিয়নের চাঁদপুর সোনারপাড়া গ্রামের জিহাদ এবং রাইসুল নামের দুইজন মূল হোতাও আছে। ২দিন পূর্বে অভিযুক্ত রাইসুলকে পুলিশ মৌখিক  অভিযোগে গ্রেফতার করলেও সে এসএসসি পরীক্ষার্থী হবার কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ভুক্তভোগীরা তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে অসহায় নিঃস্ব এবং হতাশ হয়ে পড়েছে। তারা জেলা পুলিশের সুদৃষ্টি কামনা করে দোষীদের অতিদ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।

এব্যাপারে বগুড়া সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নুরে আলম জানিয়েছেন, “অভিযোগের প্রেক্ষিতেই অনলাইন প্রতারণার একজন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য আসামীদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান আছে। এছাড়াও আরো অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ লিখিত আকারে প্রমাণ সহ জানিয়েছে। মামলা দায়ের করে আসামীদের গ্রেফতার করা হবে। এবং যারা ভুক্তভোগী আছেন তারাও লিখিত অভিযোগ  করতে পারবেন। কোন অপরাধীই ছাড় পাবেনা”।