যে কারণে দেশীয় ইন্টারনেটে এত ধীর গতি

সুপ্রভাত বগুড়া (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি): মোবাইল ইন্টারনেটের গতির দিক দিয়ে ভারত কিংবা পাকিস্তানের থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বাংলাদেশের চাইতে দক্ষিণ এশিয়ায় কম গতির ইন্টারনেট কেবল আফগানিস্তানে। এমনকি আফ্রিকার দরিদ্র দেশ বলে পরিচিত ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার চাইতেও খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের। স্পিডটেস্টের গ্লোবাল ইনডেক্সের গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশ করা সূচকের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে।

বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরগুলো অনেকদিন ধরেই ৪জি গতির ইন্টারনেট সেবা দিয়ে আসছে বলে দাবি করে। এমনকি খুব শিগগিরই তারা ইন্টারনেটের নবতম প্রযুক্তি ৫জি সেবা দেবে এমন কথাবার্তাও শোনা গেছে। কিন্তু গতির যে অবস্থা তাতে ৫জির গল্প শোনানো বিলাসিতা বলে মনে করছেন দেশের মোবাইল গ্রাহকরা।যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাহক বাড়ালেও মোবাইল অপারেটরগুলো সে অনুযায়ী নেটওয়ার্ক না বাড়ানোর কারণেই গতি অনেক কম। যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাব্বির ইন্ডিপেনডেন্টকে বলেন, গত কয়েক বছরে মোবাইল অপারেটরগুলো প্রচুর প্রফিট করেছে।

Pop Ads

গ্রাহক বাড়লেও গত দু/আড়াই বছরে তারা নতুন করে কোনো টাওয়ার বসায়নি। ফলে নেটওয়ার্ক গ্রাহকদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। এতে নেটওয়ার্কে চাপ পড়ছে এবং গতি কমে যাচ্ছে। তাছাড়া করোনায় ইন্টারনেট চাহিদাও বেড়েছে। ফলে গতি আরো কমে গেছে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলে আশা টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর। তিনি ইন্ডিপেনডেন্টকে বলেছেন, গতি কম হওয়ার অন্যতম একটি কারণ মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে পরিমাণে ইন্টারনেট গ্রাহক রয়েছে তার চাইতে স্পেকট্রাম বা তরঙ্গের পরিমাণ কম।

এরকম পরিস্থিতিতে ৮ই মার্চ নতুন স্পেকট্রাম বরাদ্দের জন্য নিলাম আয়োজন করা হচ্ছে। এই নিলাম থেকে অপারেটররা প্রয়োজনীয় স্পেকট্রাম কিনে নেয়ার পর ইন্টারনেট সেবার অগ্রগতি হবে। তবে স্পেকট্রাম একমাত্র সমস্যা নয়। গ্রাহকদের দিক থেকেও সমস্যা রয়েছে। অনেক গ্রাহক ফোরজি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন। কিন্তু তার ফোন সেট ২জি সাপোর্ট করে। ফলে তিনি তো গতি পাবেন না।

মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার আরো বলেন, ‘২টি অপারেটর ছাড়া বাকিদের স্পেকটার্মের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা এ নিয়ে বার বার তাদের বলেছি। তারাও অবস্থার উন্নতি ঘটাবে বলে জানিয়েছে। তাছাড়া টাওয়ার কম্পানিগুলোকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে নতুন করে টাওয়ার বসানোর জন্য। ইতোমধ্যে টাওয়ার বসানোর কাজ শুরুও হয়েছে।’

স্পিডটেস্টের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান :
প্রতিষ্ঠানটি মোট ১৪০টি দেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি জরিপ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। যা গত বছরের চাইতে এক ধাপ পিছিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মালদ্বীপ। দেশটির অবস্থান ৪৫তম। এরপরেই ৮৮তম অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমার। নেপালের অবস্থান ১১৪তম। এর চার ধাপ পিছিয়ে ১১৮তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। ১২০তম অবস্থানে শ্রীলঙ্কা। ভারত ১৩১তম অবস্থানে। এবং সবচেয়ে নীচে ১৪০তম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান।

মোবাইলের ইন্টারনেটের গতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ১৮৩ এমবিপিএস এর বেশি। তার পরেই রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, কাতার, চীন, সৌদি আরব, নরওয়ে, কুয়েত ও অস্ট্রেলিয়া। এই প্রতিটি দেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ১০০-১৭০ এমবিপিএস এর বেশি। সে হিসেবে ১৩৬তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ১০.৫৭ এমবিপিএস। যেটা কিনা ভারতে ১২.৪১ এমবিপিএস এবং পাকিস্তানে প্রায় ১৮ এমবিপিএস।

অবশ্য ওই একই সূচকে ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে অন্য অনেক দেশের চাইতেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। সেখানে ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬। যা গত বছরের চাইতে এক ধাপ এগিয়ে এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ডাউনলোড গতি গড়ে ৩৩.৫৪ এমবিপিএস বলে ওই সূচকে উঠে এসেছে। সে হিসেবে তুরস্ক, গ্রীসের চাইতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এমনকি মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ার চাইতেও বাংলাদেশ এই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গতিতে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে।

বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের স্পিড বেশি থাকার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে এই ইন্টারনেট মানুষ কেবলের মাধ্যমে ব্যবহার করে। যেখানে কিনা মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্পেকট্রাম বা বেতার তরঙ্গ। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের এই কেবল দেশের প্রতিটি পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার কারণে নেটওয়ার্ক পেতে কোন সমস্যা হয় না।

মোবাইল ডাটা গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা :
বাংলাদেশের যেসব মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের একটি বড় অংশই যোগাযোগ, ব্রাউজিং বা বিনোদনের ক্ষেত্রে মোবাইল ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই মোবাইল ইন্টারনেটের গতি নিয়ে মানুষের অভিযোগের শেষ নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাইমুনা সুলতানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয়। তার নিজের একটি ফেসবুক পাতা ও ইউটিউব চ্যানেল আছে, যেখানে তিনি লাইভ স্ট্রিম করেন, ছবি/ভিডিও আপলোড করেন। কিন্তু সম্প্রতি প্রয়োজনীয় গতির ইন্টারনেট সেবা না পেয়ে মোবাইলের অপারেটর বদলেছেন। কিন্তু তেমন কোন লাভ হয়নি তার।

দুটি অপারেটর তাদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও প্রচারণায় দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগের দাবি করলেও মাঝে মাঝে ঢাকার ভেতরেই সংযোগ পেতে ঝামেলায় পেন সুলতানা। বিশেষ করে কোন ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা ১২তলার ওপরে গেলে তিনি তার অপারেটর থেকে আর নেটওয়ার্ক পান না। আবার ঢাকার বাইরে অনেক জেলাতেও একই জটিলতার মুখে পড়তে হয় তাকে। এভাবে যখন তখন সংযোগ চলে যাওয়া বা ইন্টারনেট স্পিড কমে যাওয়ার কারণে তিনি যে প্যাকেজগুলো কেনেন তার বেশিরভাগই অপচয় হয়ে যায়।

মানসম্মত সেবার দাবি এমটবের :
বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠনের (এমটব) মহাসচিব এস এম ফরহাদ বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেছেন, অনেক সমস্যার মধ্যেও মোবাইল অপারেটরগুলো মানসম্মত সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তার মতে, করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালীন মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাওয়ায় সেবার মানে প্রভাব পড়েছে। তবে প্রায় ১০.৫০ এমবিপিএস গতি ফোরজি সেবার জন্য ভাল গতি হিসাবে মনে করছেন তিনি।