কেন মাকড়সা ভয় পায় মানুষ

21
কেন মাকড়সা ভয় পায় মানুষ

মাকড়সায় ভয় পাওয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে অ্যারাকোনোফোবিয়া । অনেকের এমন দুটো ভয় সবচেয়ে বেশি থাকে। সাপ এবং মাকড়সায় ভয়। বেশিরভাগ মানুষ সাপে ভয় পেলেও ৬% মানুষের মাকড়সা-ভীতি তীব্র হয়। জগতে ৩৫ হাজার জাতের মাকড়সা থাকলেও তার মাত্র .১% বিষাক্ত হয়। তার মানে ৯৯% মাকড়সা কোন ক্ষতি করে না। কিন্তু সে তুলনায় সাপ মানেই বিষ, সাপের কামড় মানেই মৃত্যু এবং বেশিরভাগ সাপ বিষাক্ত। তাই সাপের ভয় থাকাটার যৌক্তিক কিছু কারণ থাকলেও বিষহীন মাকড়সায় কেন ভয় পায় অনেক মানুষ?

এই ‘কেন’র উত্তর জানতে হলে আমাদের জানতে হবে ফোবিয়া কী। ফোবিয়া মূলত ভয়। না, সাধারণ কোনো ভয় নয়। বেশ জাঁকিয়ে বসা ভয়। পরীক্ষায় ভালো না লিখে আসলে ফলাফল দেওয়ার সময় আপনার দুশ্চিন্তা এবং ভয় হতেই পারে। তবে ফোবিয়া ঠিক সেরকম ভয় নয়। এটি একজন মানুষের মধ্যে অনেকটা পাকাপাকিভাবে এবং অতিরিক্ত মাত্রায় বাস করে। মাকড়শার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি অনেকটা একই রকম।

Pop Ads

চাঁদ মামার বয়স কতো?চাঁদ মামার বয়স কতো?
আশেপাশে কোনো মাকড়শা নেই, থাকলেও সেটি আপনাকে কোনোভাবেই আঘাত করতে পারবে না। সুতরাং এই ছোট্ট প্রাণীকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। এতকিছু জানার পরেও যদি আপনাকে কেউ বলে বসে- ঐ যে মাকড়শা! আর আপনি অসম্ভব ভয় পান, তাহলে সেটা সাধারণ ভয়ের পর্যায়ে থাকে না। এই ভয়কে আমরা এত বেশি নিজেদের মধ্যে পুষে রেখেছি যে, এটি খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যতজন মানুষই কোনো ফোবিয়া বা ভীতির ভুক্তভোগী হয়ে থাকুন না কেন, সেটি শেষ পর্যন্ত ফোবিয়াই থাকে। আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, ফোবিয়া কেন হয়? প্রশ্নের উত্তর খুব একটা সহজ নয়। ঠিক কী কারণে ফোবিয়া হয়ে থাকে সেটা এখনো পর্যন্ত জানতে পারা যায়নি। তবে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা হতে পারে আপনার কোনো ব্যাপারে ভয় পাওয়ার কারণ। তবে কিছু ফোবিয়া বা ভীতি আছে যেগুলো মানুষ জন্ম থেকেই সাথে নিয়ে আসে। আর সেগুলো হচ্ছে- উচ্চতা থেকে ভয়, অন্ধকারে ভয়, চলন্ত বস্তুতে ভয় ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই ভয়গুলো কাজ করে। আর বাকি ফোবিয়া বা ভীতিগুলোকে অর্জিত ফোবিয়া বলে। যেগুলো মানুষ আগে থেকে নয়, বরং জন্ম নেওয়ার পর শেখে।

ফোবিয়া মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। সেগুলো হল- অ্যাগ্রোফোবিয়া বা ঘরের বাইরে যাওয়ার ভয়, সোশ্যাল ফোবিয়া বা সামাজিকতায় ভয় এবং নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে ভয়। মাকড়শা নিয়ে আপনার ভয়টি শেষ রকমের ফোবিয়া বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যাপারে ফোবিয়ার মধ্যে পড়ে। তাহলে কি আপনার সাথে মাকড়শা নিয়ে এর আগে কোনো বাজে ঘটনা ঘটেছিল? সবার সাথেই কি তা-ই হয়েছে? প্রশ্ন জাগতেই পারে আপনার মনে। তবে ব্যাপারটি এত সহজ নয়। আরাকনোফোবিয়া বা মাকড়শাকে ভয় পাওয়ার এই ব্যাপারটি মানুষের মধ্যে এখন জন্ম নেয়নি। আপনি এবং বাকি সব মানুষ যে মাকড়শাকে ভয় পায়, সেটি মোটেও নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নয়। এর পেছনে আছে আমাদের পূর্বপুরুষদের হাত।

একটা সময় আমাদের প্রাচীন মানবদের কাছে না ছিল বড় হাতিয়ার, আর না ছিল কোনো উন্নত ওষুধ। আরাকনোফোবিয়ার উৎপত্তি তখন থেকে। নির্দিষ্ট এই গোত্রের প্রাণীদের কাছ থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা থাকতো তখন মানুষের। তাদেরকে প্রতিহত করার কোনো উপায় জানা ছিল না কারো। সেইসাথে আক্রমণের পর ব্যবহার করার মতো ঔষধ ছিল না তাদের কাছে। ফলে এই আক্রমণে মারা যেত অনেক মানুষ।সেখান থেকেই মাকড়শা গোত্রের যেকোনো প্রাণীর প্রতি আমাদের স্বভাবজাত ভয়ের জন্ম।

সব মাকড়সা জাল বুনে না। তবে বেশিরভাগ মাকড়সা জাল বুনে এবং সে জাল পুরনো হয়ে গেলে নিজেই তা খেয়ে ফেলে। কিছু কিছু মাকড়সা আবার অন্য জাতের মাকড়সাকে শিকার করে খায়। যেমন হান্টসম্যান স্পাইডার জাতীয় মাকড়সা। সুরিনাম এবং ভেনিজুয়েলাতে সবচেয়ে বড় জাতের মাকড়সা দেখা যায়। এ জাতের মাকড়সাকে বলা হয় বার্ড ইটার স্পাইডার, যদিও তারা পাখি ধরে ধরে খায় না। এমন মাকড়সাগুলো প্রায় এক ফিট লম্বা হয়। কিছু মাকড়সা পানির ভেতর পর্যন্ত থাকে এবং তারা মাছ খায়। নাসা একবার গবেষণার জন্য দুটো মাকড়সা মহাশূন্যে পাঠিয়েছিল। দেখতে চেয়েছে সেখানে তারা বাঁচে কিনা এবং জাল বুনে কিনা। মাকড়সা দুটো জীবিত ফিরে এসেছিল এবং মহাশূন্যে জালও বুনেছিল। ১৯২৫ সালে প্রথম অৎধপযহড়ঢ়যড়নরধ টার্মটি চিকিৎসকরা ব্যবহার শুরু করেন। ১৫% মানুষের এমন কোন না কোন ফোভিয়া আছে। মেয়েদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফোভিয়া পুরুষের তুলনায় বেশি। ফোভিয়া হলো কোন বস্তু বা পরিস্থিতির ভয়। বলা হয়, ৫০০-এর ওপরে বিভিন্ন ধরনের ফোভিয়া আছে। তার মধ্যে ১০ থেকে ১২টি খুব কমন।

বদলে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্কের ধারাবদলে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্কের ধারা
মাকড়সা-ভীতি সবার থাকে না। আবার মাকড়সা দেখলে সামান্য ভয় পেলে সেটাও ফোবিয়া নয়। ফোবিয়া কিনা তা বুঝতে কিছু লক্ষণ উপসর্গের প্রকাশ ঘটতে হয়। যেমন:

ক্সপ্রচন্ড ভয় পায়, দৌড়ে পালিয়ে যায়, জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে ভয় পেয়ে,
ক্সশ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হয়, সরাসরি দেখা দূরের কথা, ছবি দেখলে কিংবা ভাবলেও ভয় পেয়ে যায়, এমনকি ভয়ে কখনও অজ্ঞান হয়ে যায়।
মাকড়সা দেখে এমন সব প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলে বুঝতে হবে মানুষটির অ্যারাকানোফোবিয়া আছে।

এটি কেন হয়? এ নিয়ে চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা অনেক হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছে। মোটের ওপর দুটি প্রধান।
এক. মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন।
দুই. সংস্কৃতির প্রভাব।

এভালুশনারি সাইকোলজিকে এমন ভয়ের একটি কারণ ভাবা হয়। বিবর্তনের একটি সময়ে মানুষকে অন্য প্রাণীদের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হতো। ধারণা করা হয় যে, এমন মাকড়সা-ভীতি মানুষের আদিম রূপটিকে বিপদ এড়িয়ে আরও বেশিদিন বাঁচতে সাহায্য করে বলে বিবর্তনের ধারায় এটি জেনেটিক্যালি মানুষের মধ্যে ঢুকে গেছে। জেনেটিক্যালি সেটি সুপ্ত থাকলেও কারও কারও ক্ষেত্রে মাকড়সা দেখা মাত্রই মস্তিষ্কে ইমোশন সেন্টারে সিগন্যাল ট্রিগার করে, যা তার অজান্তেই ভয়ভীতির তৈরি করে।

সংস্কৃতিগত ভাবে দেখা গেছে, কোন সমাজে দীর্ঘদিন চালু থাকে এমন ভয় সংস্কৃতিগতভাবে প্রভাব রাখে বলে স্বভাবের অংশ হয়ে যায়। আফ্রিকার অনেক জাতি গোষ্ঠীর মানুষ মাকড়সা খায়। ফলে, তাদের মধ্যে মাকড়সা-ভীতি কোনভাবেই নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্যাটাগরিতে এমন ফোভিয়া লক্ষণ উপসর্গের প্রকাশসহ ছয় মাসের অধিক থাকলে তখন তাকে ফোভিয়া ধরা হয়। এটির ট্রিটমেন্ট আছে। ট্রিটমেন্ট তখনই দরকার হয়, যখন এটি দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়। যেমন, এটি সামনে না দেখলেও মনে মনে বারবার ভেবে ভয় পেয়ে যাওয়া। দুই প্রকার ট্রিটমেন্ট আছে এটি থেকে বের করে আনার। সিস্টেমিক ডিসেন্সিটাইজেশন এবং কগনিটিভ বিহেবিয়ারাল থেরাপি। ডিসেন্সিটাইজেশন প্রোসেসে মাকড়সার মুখোমুখি করিয়ে ধীরে ধীরে সহনীয় পর্যায় নিয়ে আসা। কগনিটিভ থেরাপিতে এটিকে দেখার চিন্তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ধীরে ধীরে ভীতির বস্তু থেকে ক্ষতিকর কিছু নয়, এমন চিন্তায় নিয়ে আসা।