মূল্যায়ন পদ্ধতির অসংগতিই বড় চ্যালেঞ্জ

8
মূল্যায়ন পদ্ধতির অসংগতিই বড় চ্যালেঞ্জ

যথাযথ পাইলটিং ছাড়া অনেকটা তাড়াহুড়া করে গত বছর থেকে চালু করা হয় নতুন শিক্ষাক্রম। শিখনকালীন মূল্যায়ননির্ভর এই শিক্ষাক্রম নিয়ে বছরজুড়েই চলে আলোচনা-সমালোচনা। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় সরকারকে। অনেক অভিভাবক ও শিক্ষাবিদ রাস্তায় নেমে এই শিক্ষাক্রমের প্রতিবাদ জানান।

সব শেষে মূল্যায়ন পদ্ধতির অসংগতির কারণে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে নবনিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই এই শিক্ষাক্রম এবং এর মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

Pop Ads

জানা যায়, গত বছর থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এ বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি এই শিক্ষাক্রমের আওতায় এসেছে।

২০২৫ সালে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং এবং দশম শ্রেণি যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণি যুক্ত হবে।

জানতে চাইলে নবনিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘প্রয়োজন সাপেক্ষে নতুন কারিকুলামের মূল্যায়নে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে কারিকুলাম নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে।

এর পরও সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই আলোচনা-সমালোচনাগুলো মাথায় রেখেই দুর্বলতা থাকলে, সমস্যা থাকলে সেগুলো সমাধান করতে হবে। মূল্যায়নের জায়গায় একটা আলোচনা আছে, মূল্যায়নটা যেন এমন না হয় যাতে সেটা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে পরিণত হয়—সে বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রয়েছে।’

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। ধারাবাহিক মূল্যায়নের কাজগুলোও শুরু হয়েছে।

খানে কাজ করতে গিয়ে দেখা যাবে, যে পদ্ধতি এরই মধ্যে শিক্ষাবিদরা, কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা নির্ধারণ করেছেন, সেটার মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থাকে সেটা আমরা এখন দেখতে পাব। তো দেখতে পেলে আমরা আগেও বলেছি যে এটা স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। এটা যে আমাদের রিজেক্টলি মেইনটেন করতে হবে তা কিন্তু নয়। সেখানে পরিবর্তন প্রয়োজনে অবশ্যই আসবে। পরিবর্তন প্রয়োজন সাপেক্ষে অবশ্যই আসবে।’

নতুন শিক্ষাক্রম চালুর শুরুতে বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে শিখবে, পরীক্ষাভীতি থাকবে না। নেই কোনো পাস-ফেল। আর এভাবে চলতে থাকলে এমনিতেই কোচিং ও নোট-গাইড বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন বছর শেষে যখন চূড়ান্ত মূল্যায়ন নির্দেশিকা প্রকাশ করা হলো, তখন পাস-ফেল ঠিকই রাখা হলো।

নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, একজন শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ চিহ্ন দেবেন শিক্ষকরা। এখানে ত্রিভুজকে সবচেয়ে দক্ষ বা ভালো, বৃত্তকে মোটামুটি ভালো এবং চতুর্ভুজকে উন্নতি প্রয়োজন হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর একজন শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে স্কুলে উপস্থিতির হার ও বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতাকে বিবেচনা করা হবে। ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকলে তাকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা যাবে। তবে তিনটি বিষয়ের ট্রান্সক্রিপ্টে কোনো শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা যদি ‘চতুর্ভুজ’ থাকে, তাহলে তাকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তরণের জন্য বিবেচনা করা যাবে না। আর পারদর্শিতার বিবেচনায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ক্লাসে উপস্থিতি কম হলে পরের ক্লাসে তাকে উঠতে দেওয়া হবে কি না, তা শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নেবেন।

তবে গত বছর নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নানা অসংগতি ধরা পড়েছে। অনেক স্কুলে যথাযথ মূল্যায়ন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অবিচারের শিকার হয়েছে। কারণ বেশির ভাগ স্কুল গড়পড়তা উপস্থিতি দিয়েছে শিক্ষার্থীদের। এতে কেউ বেশি স্কুলে এসে যে মূল্যায়িত হয়েছে, আবার কম উপস্থিতিতেও একই রকম মূল্যায়িত হয়েছে। অনেক স্কুলে শ্রেণি শিক্ষকের কাছে পড়লে ভালো মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার শিক্ষকদের যেহেতু মূল্যায়ন শিটে ‘চতুর্ভুজ’ দিলে কেন তা পেল তার কারণ জানাতে হয়, এ জন্য ছোট স্কুলগুলো সবাইকে ‘ত্রিভুজ’ দিয়ে গেছে। নতুন শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের রোল নম্বর কিভাবে নির্ধারিত হলো তার যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারছে না স্কুলগুলোও। ফলে মূল্যায়নব্যবস্থা নিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম ভালো, যা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন হয়তো বছর বছর চলতে থাকবে। কিন্তু মূল্যায়নব্যবস্থার পরিবর্তন এর আগেও করা সম্ভব। আপাতত শিখনকালীন মূল্যায়ন কমিয়ে পরীক্ষার নম্বর বাড়ানো প্রয়োজন। আর সেই মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনের কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। প্রয়োজনে আগের গ্রেডিং পদ্ধতির আরো উন্নয়ন করে তা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।

অভিভাবকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত পরীক্ষা নেই বললেই চলে। মূলত রয়েছে বিভিন্ন একক বা দলগত কাজ। আর দলগত কাজ একজন শিক্ষার্থীর ওপর নির্ভর করে না। এতে দলের এক-দুজন খারাপ করলে সবাই বৃত্ত বা চতুর্ভুজ পেয়ে যায়। এ ছাড়া শিক্ষকরা যদি শিক্ষার্থীকে বৃত্ত বা চতুর্ভুজ দিয়ে দেন তাহলে কিছু করার নেই। তাই আগে যে অভিভাবক দুজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়াতেন, তিনি এখন অন্তত পাঁচ-ছয়জনের কাছে প্রাইভেট পড়ান। আর এত দিন আমরা জিপিএর পেছনে দৌড়ানো লাগলেও এখন ‘ত্রিভুজে’র পেছনে দৌড়াতে হচ্ছে। তাহলে জিপিএ বাদ দেওয়ার কী দরকার ছিল?

জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারেননি। কারণ শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেলেও অনেকেই তা ধারণ করতে পারছেন না। একটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে ক্লাসের সবাইকে বোঝানো একজন শিক্ষকের পক্ষে কষ্টকর। আবার ক্লাস টাইম প্রায় আগের মতোই থাকায় শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের সেভাবে বোঝাতে পারছেন না। এ ছাড়া অনেক স্কুলেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরিসহ নানা উপকরণ নেই। ফলে ব্যাবহারিক কাজগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।

রাজধানীর কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূল্যায়ন নিয়ে অভিভাবকরা অন্ধকারাচ্ছন্ন আছেন। তাঁরা আট থেকে দশ পৃষ্ঠার ফলাফল বুঝতে পারছেন না। এমনকি মফস্বলের অনেক শিক্ষকও তা বুঝছেন না, যা পরিষ্কার করাটা খুবই জরুরি। এ ছাড়া আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিখনকালীন মূল্যায়নে অধিক পরিমাণ নম্বর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। এতে কেউ কেউ প্রভাবিতও হতে পারে। শিক্ষকরাও এ ব্যাপারে এখনো শতভাগ প্রস্তুত হতে পারেননি। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের বোঝাতে ক্লাসের সময় বাড়ানো দরকার। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতও একটা স্ট্যান্ডার্ড জায়গায় আনাটা জরুরি।’

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নপদ্ধতি

প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষায় বসতে হবে না। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৪০ শতাংশ সমষ্টিক মূল্যায়ন। এ ছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন থাকবে।

নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন ও ৫০ শতাংশ সমষ্টিক মূল্যায়ন থাকবে। এ ছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। আর দশম শ্রেণি শেষে দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। নবম-দশম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ বিভাজনও থাকছে না।

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয়ে ৩০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৭০ শতাংশ সমষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। নৈর্বাচনিক ও বিশেষায়িত বিষয়ে কাঠামো ও ধারণায়ন অনুযায়ী সমষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যাবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। এ ছাড়া একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতি বর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। একদাশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।