জ্বর পরীক্ষার থার্মোমিটারও নেই যে সরকারি হাসপাতালে!

3
জ্বর পরীক্ষার থার্মোমিটারও নেই যে সরকারি হাসপাতালে!

মাদারীপুরের সরকারি ৫টি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ২৬৮টি পদ খালি দীর্ঘদিন। এসব হাসপাতালে কাঙিক্ষত সেবা না পেয়ে রোগীদের ভরসা এখন প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতাল। আর এতে রোগীর স্বজনদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। তবে সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, জনবলের চাহিদা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে, চাহিদা পূরণ হলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
গাছ থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে যায় মাদারীপুর সদর উপজেলার কমলাপুরের ১২ বছরের নিশাদের। মা কনিকা রানী ও দাদা নির্মল রুদ্র নিয়ে আসেন ২৫০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নিশাদকে পাঠানো হয় পাশের প্রাইভেট ক্লিনিকে। সেখানে রক্ত পরীক্ষা ও এক্সরে করাতে খরচ হয় ১৭০০ টাকা। অথচ, এ পরীক্ষার যন্ত্রপাতি সরকারি হাসপাতালে থাকলেও মেলেনি সেবা।

আহত নিশাদের দাদা নির্মল রুদ্র বলেন, ‘নামেমাত্র জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকি সবকিছুই প্রাইভেট ক্লিনিকে করতে হয়েছে। শুধুমাত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য খরচ হয়েছে ১৭০০ টাকা। গরিব মানুষ আমরা, সরকারি হাসপাতালে এলে সেবা পাচ্ছি না।’

Pop Ads

এছাড়া শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া ৫ মাসের মিম, দেড় বছরের আতিক, আর আড়াই বছরের রুবেলের রক্ত, কফ ও এক্সরেসহ সব পরীক্ষাই করাতে হয়েছে বেসরকারি ক্লিনিকে। এতে গুণতে হয়েছে বাড়তি অর্থ। ফলে সরকারি হাসপাতালে সেবা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ রোগী ও স্বজনরা।

কালকিনি, রাজৈর ও শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অবস্থাও একই রকম। সরকারি হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে রোগীরা ছুটছেন প্রাইভেট ক্লিনিকে। চিকিৎসকের ফি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে রোগীর ‘গলা কাটছেন’ ক্লিনিক মালিকরা। অথচ সরকারি হাসপাতালে থাকা সিটিস্ক্যান মেশিন, ডিজিটাল এক্সরে, আল্ট্রাসোনোগ্রাম মেশিনসহ অধিকাংশ যন্ত্রপাতি অলস পড়ে থাকে।

সদর উপজেলার খোয়াজপুর থেকে আসা শিশু সাইফা মনিরের বাবা শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার মেয়ে অসুস্থ হবার পর জেলা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করি। পরে চিকিৎসক রক্তের গ্রুপ ও এক্সরে পরীক্ষা দেন, এগুলো সরকারি হাসপাতালে হবে না বলে জানান। বাধ্য হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাই, এতে ১১০০ টাকা খরচ হয়।’

মাদ্রা এলাকা থেকে আসা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আতিকুর খানের মা সাথী আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলের জন্য এক্সরে করাতে হাসপাতালে নিচের ফ্লোরে যাই, তখন বলে এক্সরে মেশিনে সমস্যা। বাইরে থেকে করে আনতে হবে। তখন, বাইরেই প্রাইভেট ক্লিনিকে এক্সরে করিয়ে আনলাম।’

মোস্তফাপুর থেকে আসা বিলকিস বেগম বলেন, ‘আমার ছোট্ট সন্তানকে ভর্তি করি ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালে। ভর্তি হবার পর থেকেই সকাল-বিকেল দুই বেলাই ওষুধ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুই বাইরে থেকে কিনতে হয়। জ্বর পরীক্ষার থার্মোমিটার, সেটাও নেই সরকারি ২৫০ শয্যা হাসপাতালে। বাচ্চার গ্যাস দেব, সেই মেশিনটিও নেই হাসপাতালে। এটা শুধু নামেই সরকারি হাসপাতাল।’

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ২৫০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতাল, ৫০ শয্যা করে তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ২০ শয্যার কবিরাজপুর হাসপাতালে মোট পদ ৮৬১টি, মঞ্জুর করা পদ ৫৯৪টি, শূন্য পদের সংখ্যা ২৬৮টি।

এরমধ্যে মাদারীপুর জেলা সদর হাসপাতালের মোট ১৬৪ জনবলের বিপরীতে আছে ১৩৫ জন। খালি পদের সংখ্যা ৩০টি। এরমধ্যে শূন্য রয়েছে ৭ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ। কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ২২০ জনবলের বিপরীতে আছে ১৪৪ জন। খালি পদের সংখ্যা ৭৬টি। এরমধ্যে শূন্য রয়েছে ১৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ। রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ১৯৯ জনবলের বিপরীতে আছে ১৪১ জন। খালি পদের সংখ্যা ৫৮টি। এরমধ্যে শূন্য রয়েছে ৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ। শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ২৫৩ জনবলের বিপরীতে আছে ১৬৭ জন। খালি পদের সংখ্যা ৮৬টি। এরমধ্যে শূন্য রয়েছে ১০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ। এছাড়া রাজৈরের ২০ শয্যাবিশিষ্ট কবিরাজপুর হাসপাতালের মোট ২৫ জনবলের বিপরীতে আছে ৭ জন। খালি পদের সংখ্যা ১৬টি। এরমধ্যে শূন্য রয়েছে ৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, জেলা সদর ও তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন গড়ে ভর্তি হন ৩০০ থেকে ৪০০ রোগী। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন ২ হাজার মানুষ।

‘নিরাপদ চিকিৎসা চাই’ মাদারীপুর জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মশিউর রহমান পারভেজ বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সাধারণ রোগী কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ হচ্ছে, কিন্তু সেবার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। জেলাবাসীর দাবি, জেলাতেই রোগীদের জন্য সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হোক সরকারি হাসপাতালগুলোতে।’

মাদারীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মুনীর আহম্মেদ খানের দাবি, জনবল সংকটে অতিরিক্ত চাপে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবু সাধ্যমতো চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। জনবল সংকট থাকায় মাঝে মাঝে একটু বেগ পেতে হয়। জনবলের চাহিদা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে, চাহিদা পূরণ হলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খান বলেন, ‘জেলা সদর হাসপাতাল ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু জনবল সেই আগের মতোই রয়েছে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি মন্ত্রণালয় জড়িত থাকে, তাই চাইলেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। তবুও স্বাস্থ্য বিভাগ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এ জনবল নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। আশা করি অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’