হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই

4
হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই

রোগীদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। এ অবস্থায় চিকিৎসকেরা হিমশিম খাচ্ছেন।
বেলা সাড়ে ১১টা। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের নার্সদের কক্ষে মা শারমিন আক্তারের কোলে ছয় মাস বয়সী শিশু লাবিব অনবরত কেঁদেই চলেছে। ওয়ার্ড ইনচার্জ রেহেনা খাতুন শিশুটির শরীরে ইনজেকশন পুশ করার সময় আরও জোরে কেঁদে ওঠে। তার কান্না দেখে মা শারমিনও ফুপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

রেহেনা বলেন, ছেলে কয়েক দিন ধরে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত। চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুটির খাওয়ার ওষুধের পাশাপাশি ইনজেকশন ও স্যালাইন দিতে ক্যানুলা লাগানো হলো। এখানে তাঁর ছেলের মতো আরও অনেক অসুস্থ শিশু আছে। রোগীদের ভিড়ে শয্যা পাওয়া যায়নি।

Pop Ads

শুধু চুয়াডাঙ্গা নয়, প্রচণ্ড গরমে খুলনা, মাদারীপুর আর মাগুরার হাসপাতালগুলোতেও তিলধারণের জায়গা নেই। রোগীদের মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি।

চিকিৎসকেরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমনিতেই রোগীদের ভিড় থাকে। এখন আবহাওয়ার কারণে রোগীদের যেন স্রোত নেমেছে। এ অবস্থায় তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, ২০ শয্যার ওয়ার্ডে ৬৩ জন রোগী আছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৯৬ জন চিকিৎসাধীন। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ঢুকে দেখা যায়, ছয় মাস বয়সী শিশু আছিয়াকে কোলে করে বসে আছেন নানি হাওয়া বেগম ও মা মেঘনা খাতুন। বমি ও পাতলা পায়খানায় নেতিয়ে পড়া শিশুটির শরীরে চলছে স্যালাইন।

সদর হাসপাতালের শিশু বিভাগের পরামর্শক আসাদুর রহমান মালিক বলেন, চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে হাসপাতালে রোগীর চাপও বেড়েছে। শিশুরা এখন সাধারণত জ্বরে পাশাপাশি ঠান্ডাজনিত সমস্যা ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আতাউর রহমান মুন্সী জানান, ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে ১০০ শয্যার এ হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। ১০০ শয্যার বিপরীতে নিয়মিত ৩৫০ জনের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এখনকার বাড়তি এই চাপ সামলাতে হিমশিম অবস্থা। এখন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়া ভালো। প্রচুর পরিমাণ স্বাভাবিক পানি পান করতে হবে। ফ্রিজের ঠান্ডা পানি এড়িয়ে চলতে হবে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫০০ শয্যার ওই হাসপাতালে গতকাল ১ হাজার ৩৪২ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন, যা ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ বেশি। শিশু ওয়ার্ডে ৪৮টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি রয়েছে ১২৪ জন। হাসপাতালের মেঝে, বারান্দায় পা ফেলারও জায়গা নেই।

ওই ওয়ার্ডের বারান্দায় ৬ মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন মনজিলা বেগম। তাঁদের বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলায়। তিনি জানান, ছেলের শ্বাসকষ্ট হওয়ায় তাঁরা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পরে জানতে পারেন, নিউমোনিয়া হয়েছে।

ওই ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার চিকিৎসক মো. আবু জাহিদ বলেন, গরমে শিশুরা বেশি সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেশি।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক চিকিৎসক হুসাইন শাফায়াত বলেন, গরমের কারণে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। অন্য রোগী স্বাভাবিকের মতোই রয়েছে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত কোনো রোগীর কথা এখনো জানা যায়নি।

মেহেরপুরের সদর উপজেলার আকলিমা খাতুনের বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। পাঁচ দিন ধরে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। গত রোববার মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। শয্যা না পেয়ে ওয়ার্ডের প্রবেশমুখে বিছানা বিছিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে কোনো জায়গা নেই। এ জন্য একানে এমাকে বিছনা কইরি দি চিকিৎসা দিচ্ছে। এখনো শরীর ভালো হয়নি।’

গতকাল হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ২০ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলেন ১০০ জনের বেশি। বেশির ভাগ রোগী বারান্দা, মেঝে, সিঁড়িতে জায়গা পেয়েছেন। সেখানে বৈদ্যুতিক পাখা নেই। গরমে রোগীদের অবস্থা কাহিল।

জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, গরম পড়ার কারণে হাসপাতালে বহির্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় ৯০০ জন রোগী। ১০০ শয্যার বিপরীতে হাসপাতালে মোট রোগী ভর্তি রয়েছেন ৪২১ জন।

হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক হাসিবুস সাত্তার বলেন, প্রচণ্ড তাপে, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বেশির ভাগ গরমজনিত রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসাসেবা দিতে জনবলসংকট ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। যাঁরা মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করতে খুলনা বিভাগীয় অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়েছে।

মাগুরা সদর উপজেলার বেড় আকসি গ্রামের বাসিন্দা চায়না বেগমের ১০ মাস বয়সী নাতি ছেলে এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে আক্রান্ত। ৫ দিন ধরে এই শিশু ভর্তি রয়েছে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে। কিন্তু তাঁরা শয্যা পাননি। কদিন ধরেই হাসপাতালে তৃতীয় তলায় মেঝেতে পাটি বিছিয়ে আছেন তাঁরা।

চায়না বেগম বলেন, ‘ওপরে ফ্যান নেই। এ কারণে বাড়ি থেকে দুটি ফ্যান নিয়ে এসেছি। একটা চার্জার ফ্যান আছে, যাতে বিদ্যুৎ না থাকলেও বাতাস পাওয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে রোগীদের অনেক চাপ। প্রতিদিন চিকিৎসক এলেও পরিচ্ছন্নতাকর্মী আসেন না। এ কারণে নিজেরাই যত দূর সম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখছেন।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে রোগীর চাপ বেড়েছে। ২১ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত অন্তর্বিভাগে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৩৭। আর ২১ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৩৪। ৮ দিনে হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৪৬৬ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।

চুয়াডাঙ্গায় সদর হাসপাতালে শিশুর হাতে ক্যানুলা লাগাচ্ছেন নার্সরা। গতকাল দুপুরে
চুয়াডাঙ্গায় সদর হাসপাতালে শিশুর হাতে ক্যানুলা লাগাচ্ছেন নার্সরা। গতকাল দুপুরেছবি: প্রথম আলো

হাসপাতালে দায়িত্বরত শিশু চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডায়রিয়ায় পাশাপাশি জ্বর, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। ৫৮ জন চিকিৎসকের পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ২৪ জন। চতুর্থ শ্রেণির ৬৪টি পদ থাকলেও সেখানে আছেন ৩৮ জন। ফাঁকা রয়েছে ২৬টি পদ।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা বিকাশ কুমার শিকদার বলেন, পরিস্থিতি এমন যে চিকিৎসকেরাই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। একেকজন চিকিৎসককে বহির্বিভাগে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ রোগী দেখতে হয়। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংকট আছে। ফলে সবাই চাপের মুখে আছেন।