ডেঙ্গুতে দিনে ৯১৯ আক্রান্ত, মৃত্যু ৫

15
ডেঙ্গুতে দিনে ৯১৯ আক্রান্ত, মৃত্যু ৫

ডেঙ্গুর সংক্রমণ সারা দেশে। সমস্যা সারা বছরের। দরকার বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ বছর প্রতিদিন গড়ে ৯১৯ জন মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এঁদের মধ্যে দৈনিক গড়ে ৫ জন করে মারা যাচ্ছেন। মৃতদের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু ১৬৬ জন। গণমাধ্যমে পাঠানো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে এটা ডেঙ্গুর পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। সরকারি তথ্যের বাইরে বহু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এঁদের একটি অংশ নিজেদের মতো করে চিকিৎসা নিয়েছে, অনেকে আবার চিকিৎসা নেননি। সরকারি হিসাবের বাইরে আক্রান্তদের সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তার চার থেকে পাঁচ গুণ মানুষ বাস্তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত থাকেন। সেই হিসাবে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১২ থেকে ১৫ লাখ মানুষ।

Pop Ads

বছর শেষ হতে এখনো ১৯ দিন বাকি। এরই মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫৬ জন। এঁদের মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৬৬৭ জন। বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে এত আক্রান্ত ও মৃত্যু এর আগে হয়নি। এ বছর বিশ্বে আর কোনো দেশে ডেঙ্গুতে এত মৃত্যুও হয়নি। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হলেও দেশটিতে মৃত্যু এক হাজারের কম।

মনে রাখতে হবে এটি একক কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। কাজটি করতে হবে বছরজুড়ে, বছরের পর বছর এবং সারা দেশে। আজ শুরু করলে কয়েক বছর পর সুফল পাওয়া যাবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদেরা অভিযোগ করে আসছেন, সরকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বা কর্মসূচি নেই। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেই সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসে। শীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে এলে সরকারের কোনো কাজ আর চোখে পড়ে না। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর আমরা দেখছি ডেঙ্গু সারা বছরের ও সারা দেশের রোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্যের জটিল ও কঠিন এক সমস্যার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বছরজুড়ে, দেশজুড়ে কাজ না করলে আগামী বছরগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়বে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি বেড়ে যাবে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়।’

তবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেরিতে হলেও সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কৌশলপত্রের খসড়া তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে এই খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে এ নিয়ে জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে।

২০০০ সাল থেকে দেশে নিয়মিত ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। অতীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মূলত ঢাকা শহরেই দেখা গেছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বড় বড় শহরে ডেঙ্গু দেখা গেলেও তার বিস্তার ছিল কম। তবে ২০১৯ সালে বেশ কয়েকটি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছিল।

এ বছর ৬৪ জেলার মানুষই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তদের ৬৬ শতাংশ ঢাকা শহরের বাইরের মানুষ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৩ হাজার, বরিশাল বিভাগে ৩৭ হাজার এবং খুলনা বিভাগে ৩৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয়েছেন সিলেট বিভাগে। এই বিভাগের চারটি জেলায় ১ হাজার ৪২৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন, আর মারা গেছেন একজন।

চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের বড় অংশ উপকূলীয় অঞ্চল। উপকূলের এই জেলাগুলোতে কেন ডেঙ্গু ছড়াল, আবার সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে কেন ডেঙ্গুর সংক্রমণ তুলনামূলক কম, তার কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ স্বাস্থ্য বিভাগ করেনি।

এ বছর ১৫ বছরের কম বয়সী ১৬৬ জন শিশু মারা গেছে ডেঙ্গুতে। ডেঙ্গুতে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।

বিপদের অন্য দিকটি হচ্ছে, শীতকালেও মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নিয়মিত মারা যাচ্ছেন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল আটটা থেকে মঙ্গলবার সকাল আটটা পর্যন্ত) সারা দেশে ৩১১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ে মারা গেছেন ২ জন। এ নিয়ে এই ডিসেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৬৫ জন ও মারা গেছেন ৪৫ জন।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা আশঙ্কা করছেন, পুরো শীতজুড়ে এই সংক্রমণ সারা দেশেই চলতে থাকবে এবং মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হলে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর কর্মসূচি না থাকায় বৃষ্টিতে মশা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে ডেঙ্গু। শীত শেষে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

নারীর পাশাপাশি শিশুমৃত্যু বেশি
ডেঙ্গুতে নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বা হয়েছেন। সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৬০ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ শতাংশ নারী।

তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে বেশি মৃত্যু হচ্ছে নারীর। এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ১ হাজার ৬৬৭ জনের মধ্যে নারী ৯৫৪ জন বা ৫৭ শতাংশ। আর পুরুষ ৭১৩ জন বা ৪৩ শতাংশ।

কেন নারীর চেয়ে পুরুষ ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, আবার কেন পুরুষের চেয়ে নারী বেশি মারা যাচ্ছেন, তার সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

এ বছর ১৫ বছরের কম বয়সী ১৬৬ জন শিশু মারা গেছে ডেঙ্গুতে। ডেঙ্গুতে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশের অনেক জেলায় শিশুদের ডেঙ্গু চিকিৎসার পর্যাপ্ত আয়োজন নেই। দেশের ৩০টির বেশি জেলার শিশুদের এ বছরের বিভিন্ন সময় এই হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়েছে চিকিৎসার জন্য।

দরকার বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা
কোনো ভূখণ্ডে একবার ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলে সেখান থেকে চিরতরে ডেঙ্গু নির্মূলের কোনো নজির আছে বলে জানা যায় না। তবে কার্যকরভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বহু নজির বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা ও ঢাকা শহরে গত শতকের ষাটের দশকে প্রায় একই সময়ে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। কলকাতায় ডেঙ্গু এখন নিয়ন্ত্রণে, ঢাকায় নিয়ন্ত্রণহীন। পরিকল্পিত কর্মসূচি সারা বছর ধরে বাস্তবায়নের সুফল ভোগ করছে কলকাতার মানুষ। আর পরিকল্পিত কর্মসূচির অভাবে ভুগছে ঢাকার তথা বাংলাদেশের মানুষ।

২০১৭ ও ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দুজন বিশেষজ্ঞ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণে স্বাস্থ্য বিভাগকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই পরামর্শ কেউ শোনেনি। অবশ্য গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ১০ বছর মেয়াদি কর্মকৌশল হাতে নিচ্ছেন তাঁরা। খসড়া কর্মকৌশলে সারা বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা আছে।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কীটতত্ত্ববিদদের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও গ্রামের মানুষ। মনে রাখতে হবে এটি একক কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। কাজটি করতে হবে বছরজুড়ে, বছরের পর বছর এবং সারা দেশে। আজ শুরু করলে কয়েক বছর পর সুফল পাওয়া যা