তাঁকে বলা হতো বাংলার এলভিস প্রিসলি

79
তাঁকে বলা হতো বাংলার এলভিস প্রিসলি

নিজের সময় তো বটেই, পরের সব প্রজন্মকেই প্রভাবিত করেছেন রক অ্যান্ড রোলের রাজা এলভিস প্রিসলি। শুধু গান দিয়ে নয়, ব্যক্তিত্বের আবেদন, পোশাক, স্টাইল সব মিলিয়ে প্রিসলি যেন ছিলেন এক গল্পের রাজকুমার! এখনো এলভিস প্রিসলি চর্চা হয় সংগীত অনুরাগীদের মধ্যে।
লেখাটা এলভিস প্রিসলিকে দিয়ে শুরু হলেও আজকের বিষয় তিনি নন। তাঁর নাম এসেছে, কেননা আমাদের দেশেও তেমন একজন ‘এলভিস প্রিসলি’ ছিলেন। গান করতেন। ছিলেন নায়ক।

ব্যক্তিত্ব, পোশাক, স্টাইল সব মিলিয়ে তিনি যেন ছিলেন এক গল্পের রাজকুমার। তিনি প্রয়াত চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল। আজ ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ভক্তরা তাঁকে বলতেন, বাংলার এলভিস প্রিসলি। হয়তো তিনি নিজেও প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রিসলিতে।
তাঁর সময়ের অভিনেতার মধ্যে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। নিজস্বতা ছিল তাঁর অভিনয়ে। সাবলীল, কিন্তু চিত্ত হরণে অনন্য। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে কজন বড় পর্দার অভিনেতা এসেছিলেন, নায়ক হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম জাফর ইকবাল। তিনি তাঁর সময়ের তুলনায় এগিয়ে ছিলেন। ফ্যাশনে, শরীরী ভাষায়। নায়ক হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও সংগীতশিল্পী হিসেবেই নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এই চিরসবুজ তারকা।

Pop Ads

অবশ্য তিনি যে সময়টাতে ঢাকাই চলচ্চিত্রে যখন প্রবেশ করেন, সেই সময়টাও খুব একটা অনুকূলে ছিল না। অন্তত তাঁর অনুকূলে ছিল না। অনেক নামকরা নায়ক তখন ঢাকার চলচ্চিত্র বাজারে। যে যার মতো করে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিযোগিতার মধ্যেও নিজের একটি আলাদা পরিচয় তিনি গড়ে তুলেছিলেন ঢাকার ছেলে জাফর ইকবাল। সত্তর ও আশি দশকে পর্দায় রাগী, রোমান্টিক, জীবন-যন্ত্রণায় পীড়িত তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালকদের আস্থা ছিলেন তিনি। সামাজিক প্রেমকাহিনি ‘মাস্তান’–এর নায়ক জাফর ইকবাল রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে এক গ্রামীণ তরুণের চরিত্রেও দর্শক তাঁকে গ্রহণ করেন।

শৈশবে, বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহর সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত
শৈশবে, বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহর সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত
অভিজাত পরিবারের ছেলে জাফর ইকবাল। ঢাকার গুলশানে জন্ম। জাফর ইকবালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। এক স্মৃতিচারণায় কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘জাফর ইকবাল দারুণ স্মার্ট ছিলেন। শুধু পোশাক–আশাকে নয়, ওর রুচিবোধ, ইন্টেলেকচুয়াল হাইট, ফ্যাশন সচেতনতা সবই ছিল নজরকাড়ার মতো। এই অঙ্গনে আর কারও মধ্যে এ রকম দেখিনি। আমি নিজেই দেখেছি, তাঁর বাসার ‘শু’ র‌্যাকে তিন শ রকমের জুতা। জুতা রাখার আলাদা একটা কর্নার ছিল। জুতার সঙ্গে মিল রেখে ড্রেস পরতেন। এখনকার কোনো নায়কের মধ্যেও এমন ফ্যাশন সচেতনতা আছে কি না, জানি না।’ দুর্বলতা ছিল ব্র্যান্ডের জামা, দামি সিগারেট আর পারফিউমে। দিনে ছয়বার জামা পাল্টাতেন আর সাত ধরনের পারফিউম ব্যবহার করতেন।

ক্যামেরার  মনে বা বাস্তব জীবনে জাফর ইকবালের পোশাকেও ছিল স্বতন্ত্র, জিন্সের সঙ্গে ছোট হাতা টি-শার্ট গায়ে নায়ককে তার আগে দেখা গেছে বলে মনে হয় না। এন্ডি গিবদের মতো পশ্চিমা সেলিব্রিটিরা পড়তেন তেমন টি–শার্ট। সে সময় ঢাকার তরুণেরা মার্কেটে গিয়ে নাকি বলতেন, জাফর ইকবাল মার্কা শার্ট দেন!

সংস্কৃতিমনা পরিবার ছিল জাফর ইকবালের। বাড়িতে গানবাজনা হতো। তাঁর বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহ একজন সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজও বিখ্যাত সংগীত পরিচালক। এসব সূত্রে জাফর ইকবাল প্রথমে গায়ক হিসেবেই পরিচিতি পান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে তিনি নিজের একটি ব্যান্ড গড়ে তোলেন। বন্ধু ফারুক, তোতা ও মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ব্যান্ড দল ‘রোলিং স্টোন’। ভালো গিটার বাজাতেন, কলেজের যেকোনো অনুষ্ঠানেই গিটার বাজিয়ে গাইতেন প্রিয় শিল্পী এলভিস প্রিসলির গান। ‘পিচ ঢালা পথ’ ছিল ব্যান্ড গড়ে তোলার পর তাঁর প্রথম গাওয়া গান।
ভাই আনোয়ার পারভেজের সুরে নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত ‘বদনাম’ ছবিতে প্রথম গান করেন ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও/আমি তো এখন আর নই কারও’। প্রথম প্লেব্যাকেই ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান এই অভিনেতা। এরপর সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাঁকে দিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্রে কাজ করিয়েছিলেন।

তাঁর জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ অন্যতম। নিজের কণ্ঠে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যুগে ‘সুখে থাকো নন্দিনী’ গানটি গেয়ে দারুণ সাড়া ফেলেছিলেন। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর উদ্‌যাপন বিশেষ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ গানটি। পরে শিল্পী রফিকুল আলমও গেয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের আগে জাফর ইকবাল চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। গান গেয়েই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অভিনেতা খান আতাউর রহমানের সঙ্গে। তাঁর অভিনীত প্রথম ছবির নাম ‘আপন পর’। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে। খান আতাউর রহমান পরিচালিত এ ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন কবরী।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন।

ববিতার সঙ্গে তাঁর জুটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল ঢাকাই চলচ্চিত্র অঙ্গনে। এই জুটি প্রচুর সিনেমায় জুটিবদ্ধ হয়েছেন। সে সময়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনে জাফর ইকবাল আর ববিতার সম্পর্ক নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা যেত। বিনোদন সাময়িকীগুলোতেও এসব নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল। চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকেই বলেন, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনী’ গানটি জাফর ইকবাল ববিতার জন্যই গেয়েছিলেন। তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় হতাশ হয়েই জাফর ইকবাল অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জোর গুঞ্জন উঠেছিল। অবশ্য এসবের কোন দালিলিক প্রমাণও নেই। তা ছাড়া প্রেমের বিষয়ে ববিতা বা জাফর ইকবাল কেউ-ই কখনো মুখ খোলেননি।

‘বদনাম’ ছবিতে গেয়েছেন জাফর ইকবাল। ছবি: সংগৃহীত
‘বদনাম’ ছবিতে গেয়েছেন জাফর ইকবাল। ছবি: সংগৃহীত
‘অবুঝ হৃদয়’ ছবিতে জাফর ইকবাল ও ববিতার রোমান্টিক দৃশ্যগুলো সেই গুঞ্জনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘অবুঝ হৃদয়’ ছবিতে ববিতা ও চম্পা দুই বোনের বিপরীতে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছিলেন এবং দুজনের বিপরীতেই দারুণ মানিয়ে গিয়েছিলেন। জুটি হিসেবে শুধু ববিতা নন, চম্পা, সুচরিতা, রানী, দিতি—সবার সঙ্গে দর্শক তাঁকে পছন্দ করেছিল।

তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন এমন সহশিল্পীদের স্মৃতিচারণা শুনে, সে সময়ের চলচ্চিত্রবিষয়ক সাময়িকী ফিচার পড়ে বোঝা যায়, খুব অভিমানী এবং আবেগপ্রবণ ছিলেন জাফর ইকবাল। ছিলেন বোহেমিয়ান স্বভাবের। কিছুটা রাগী। জীবনযাপনে কিছুটা অগোছালোও, মানে ঠিক প্রচলিত জীবনযাপনের ধার ধারতেন না।

‘লক্ষ্মীর সংসার’ সিনেমার দৃশ্যে দিতি, জাফর ইকবাল এবং কাবিলা
‘লক্ষ্মীর সংসার’ সিনেমার দৃশ্যে দিতি, জাফর ইকবাল এবং কাবিলাইউটি