দেশে ডেঙ্গু টিকার ‘সফল’ পরীক্ষা, চার ধরনই কার্যকর

38
দেশে ডেঙ্গু টিকার ‘সফল’ পরীক্ষা, চার ধরনই কার্যকর

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এক ডোজের ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫ মূল্যায়ন করে দেখা যায়, এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম। বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়েছে আইসিডিডিআর.বি। সম্প্রতি দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর.বি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকেরা এ টিকার সফল পরীক্ষা করেছেন।

Pop Ads

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন-ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে দেখা গেছে, চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই এ টিকা কার্যকর। টিকার এ সফল পরীক্ষা নিয়ে একটি প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘ল্যানসেট’ বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) প্রকাশ করেছে। এ টিকার নাম দেয়া হয়েছে টিভি-০০৫ (টেট্রাভেলেন্ট-০০৫)।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গবেষণায় ব্যবহৃত এক ডোজের ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫ মূল্যায়ন করে দেখা গেছে যে, এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম।

ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাস যা বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির মৃদু লক্ষণে জ্বর ও হাড়ের ব্যথা হয় এবং গুরুতর ক্ষেত্রে শক, রক্তপাত ও অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটে। সাধারণত ডেঙ্গুর চারটি ধরন (ডেন ১, ২, ৩, ৪) বা সেরোটাইপ এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে সক্রিয় থাকতে পারে। ডেঙ্গুর যেকোনো ধরন একজন মানুষকে অসুস্থ করতে পারে। তবে অন্য কোনো ধরনে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থা গুরুতর হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি, এখানে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর আকার এবং তীব্রতা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরের চলমান ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুতর এবং ঢাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ভয়ানক প্রভাব ফেলেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে তরল খাদ্য গ্রহণ এবং উপসর্গ নিয়ন্ত্রণই ডেঙ্গুর একমাত্র প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাই বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর চারটি ধরনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী টিকা উন্নয়ন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

গবেষকরা জানান, ২০১৫ সালে ডেঙ্গু ইন ঢাকা ইনিশিয়েটিভ (ডিডি) নামক গবেষণাটি শুরু করেন আইসিডিডিআর,বি এবং ইউভিএমের ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টারের গবেষকরা। এই সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল ডেঙ্গু টিকার উন্নয়নে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা। ২০১৫ থেকে ক্লিনিকাল ট্রায়াল, ল্যাবরেটরি পরীক্ষণ অবকাঠামো এবং প্রারম্ভিকভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অধ্যায়ন সংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য আইসিডিডিআর,বিতে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি করা হয়।

দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেসে প্রকাশিত এ গবেষণাটি একটি দৈবচয়নভিত্তিক এবং ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এর মাধ্যমে টিভি-০০৫ টেট্রাভ্যালেন্ট লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড ডেঙ্গু টিকার নিরাপত্তা, ইমিউনোজেনিসিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির সক্ষমতা এবং তিন বছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্বের অবস্থা মূল্যায়ন করা হয়েছে। গবেষকরা ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের (বয়স ১-৪৯ বছর) ১৯২ জন স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারীকে চারটি ভাগে ভাগ করে ৩ঃ১ অনুপাতে টিভি-০০৫ টিকা বা প্লাসিবো দিয়েছেন। এরপর তারা পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন।

এতে আরও বলা হয়েছে, টিকা দেয়ার পরে বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে চারটি ডেঙ্গুর সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। যদিও গবেষণাটির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো ঘটনা শনাক্ত করা যায়নি। গবেষণালব্ধ এ ফলগুলো ডেঙ্গুপ্রবণ জনগোষ্ঠীতে ব্যাপকহারে টিভি-০০৫ ডেঙ্গু টিকা ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তোলার পাশাপাশি, তৃতীয় ধাপের কার্যকারিতা ট্রায়াল পরিচালনার জন্য সমর্থন জোগাড় করতে সহায়তা করবে।

জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ভ্যাকসিন টেস্টিং সেন্টার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের (এনআইএইচ) তৈরি ডেঙ্গু টিকার মূল্যায়ন করে আসছে। ইউভিএম টিমের নেতৃত্বে রয়েছে প্রফেসর বেথ কির্কপ্যাট্রিক। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মেরি ক্লেয়ার ওয়ালশ, ক্রিস্টেন পিয়ার্স, ডোরোথি, শন ডিয়েল ও মারিয়া কারমোলি। তাদের ডেঙ্গু টিকা প্রোগ্রামটি ইউভিএম ভিটিসি এবং এনআইএইচের ভাইরাল ডিজিজেস ল্যাবরেটরির সিনিয়র গবেষক স্টিফেন হোয়াইটহেড (যিনি একজন ভাইরোলজিস্ট এবং টিভি-০০৫ টিকার উদ্ভাবকদের একজন) এবং জনস হপকিন্স স্কুল পাবলিক হেলথের আন্না ডারবিন এমডির সঙ্গে একটি দীর্ঘ পারস্পরিক সহযোগিতার ফসল।

আইসিডিডিআর,বি-র সঙ্গে এই সহযোগিতামূলক কাজের আগে, ইউভিএম ভিটিসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কয়েক ডজন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পরিচালনা করেছে, যা মূলত ডেঙ্গু টিকার একক ও টেট্রাভ্যালেন্ট ফর্মুলেশন এবং কনট্রোলড হিউম্যান চ্যালেঞ্জ মডেলের ছিল। আইসিডিডিআর,বি-গবেষকদের মধ্যে প্রধান গবেষক হিসেবে রয়েছেন সিনিয়র বিজ্ঞানী রাশিদুল হক। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মো. শফিউল আলম, সাজিয়া আফরিন ও মো. মাসুদ আলম।

এ বিষয়ে আইসিডিডিআর,বির গবেষক ড. রাশিদুল হক বলেন, একটি কার্যকর এবং টেট্রাভালেন্ট ডেঙ্গু টিকা বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব গুরুতর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণে টিভি-০০৫ টিকার গবেষণা করতে পেরে আমরা গর্বিত। আশা করি আমাদের কাজ ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি কার্যকর টিকা প্রাপ্তির বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করবে।

টিভি ০০৫ টিকাটি হলো এক মাত্র একক ডোজের টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু টিকা যা এই একটি টিকাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈষিষ্ট্য যোগ করেন প্রফেসর বেথ কির্কপ্যাট্রিক (ইউভিএম)। এটি ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের সবকটির বিরুদ্ধেই ইমিউন রেসপন্স তৈরি করে যা যে কোনো টেট্রাভ্যালেন্ট ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের জণ্য গুরুতত্বপূর্ণ ।

উভয় গবেষকরা আশা প্রকাশ করেন যে, এই গবেষণালব্ধ ফলাফল বাংলাদেশে ও দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উপকারী হবে।