উচ্চশিক্ষার এমন দুরবস্থা কেন

3
উচ্চশিক্ষার এমন দুরবস্থা কেন

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং বা মান নির্ণয় নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও আজকের বিশ্বে ‘দ্য টাইমস হায়ার এডুকেশন’-এর মান নির্ণয় পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় সবাই মেনে নিয়েছেন, যদিও এই পদ্ধতি শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়। এখানে গোড়ায়ই বলে রাখা প্রাসঙ্গিক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিরূপণ করা যেকোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য জরুরি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কোন পর্যায়ে আছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের অবস্থান কোথায়, বিশ্বপ্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোথায় উন্নতি দরকার—সর্বোপরি পেশাগত জীবনে আমাদের তরুণসমাজ বিশ্বমানদণ্ডের কোন স্তরে অবস্থান করছে অথবা করবে, তা জানা জরুরি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ডই বলে দেবে সার্বিক বিবেচনায় আমরা এগোচ্ছি না পিছিয়ে পড়ছি।

শিক্ষাদান ও পঠন-পাঠনকে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ডের প্রথম সূচক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। শিক্ষাদানের মান বিবেচনায় শিক্ষা কার্যক্রম (কারিকুলাম), শিক্ষাদান, ছাত্র-শিক্ষক সংখ্যানুপাত, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রমের সংখ্যানুপাত, উচ্চতম পর্যায় অর্থাৎ ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনা হয়। আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে প্রায় সর্বত্রই পঠন-পাঠনের মান নির্ণয়ের সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়। এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে।

Pop Ads

বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিজের বিষয় পদার্থবিদ্যা শিক্ষাক্রম আমি দেখেছি। লিখিত শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই যথেষ্ট মানসম্মত। কিন্তু এটি তো কিছু ছাপানো কাগজমাত্র। বাস্তবে যথেষ্ট মেধা ও শ্রম দিয়ে শিক্ষকরা এই শিক্ষা কার্যক্রমকে যথাসময়ে সম্পূর্ণভাবে শেষ করেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার এমন দুরবস্থা কেনসার্বিক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের মান, শিক্ষা কার্যক্রমের মানদণ্ড, শিক্ষকদের ডিগ্রি ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ, ছাত্রদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অভিসন্দর্ভ (থিসিস) পর্যায়ে গবেষণা তত্ত্বাবধান, শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি অনুদান ছাড়া বাৎসরিক আয়, পেশাগত জীবনে প্রাক্তন ছাত্রদের সুনাম ও সাফল্য ইত্যাদি বিষয়ের চুলচেরা বিবেচনায় টাইমস হাইয়ার এডুকেশন এ ক্ষেত্রে মোট নম্বরের ৩০ শতাংশ ধরে নিয়েছে।

প্রথম প্রশ্ন, আসলেই কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাদান ও শিক্ষা কার্যক্রমের মানদণ্ড যথেষ্ট উঁচু স্তরের? আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি (১৯৭৪-১৯৮৯), আমার বিভাগে বেশ কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন, যাঁদের মান ছিল আন্তর্জাতিক স্তরের। তাঁদের অনেকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাইরের লোভনীয় পেশা ছেড়ে চলে এসেছিলেন দেশে, মূলত দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে। বাইরের বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, ওই সব সম্মানিত শিক্ষক তাঁদের সর্বোচ্চ মেধা দিয়ে বলতে গেলে অল্প বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, মাত্র এক দশকের মধ্যেই তাঁদের বেশির ভাগের মোহভঙ্গ হয়েছে।

বাইরের সৃষ্টিশীল জীবন ও পরিবেশ ছেড়ে এসে তাঁরা ভুল করেছেন—এমন আক্ষেপ ছিল অনেকেরই।

শিক্ষায় উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম অনুসরণ করা হয় অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে। আমরা কি তা করি? যথাসময়ে সিলেবাস শেষ না করেই শিক্ষাবর্ষ শেষ করার কানাঘুষাও শুনি প্রায়ই। অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, যেসব দেশ গুণগত মানের শিক্ষায় বিশ্বাস করে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পাঁচ-ছয় বছর পর পর পুনর্মূল্যায়ন করে। এই পুনর্মূল্যায়ন কোনো বিষয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে আবার কোনো বিষয়ে কিছুটা কম। আর এই পুনর্মূল্যায়নের দায়ভার দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কোনো টিমকে, যারা সপ্তাহখানেক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, পরীক্ষাপত্রে শিক্ষা কার্যক্রমকে যথাযথভাবে বিবেচনায় আনা হয়েছে কি না তা দেখে, নমুনা খাতায় পরীক্ষকের মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে কি না তা দেখে থাকে। এরপর বিশেষজ্ঞদের এই টিম সার্বিক বিষয় বিবেচনায় এনে তাদের নির্মোহ প্রতিবেদন তৈরি করে প্রতিটি বিভাগে জমা দেয় যথাযথ সুপারিশ আকারে। সেই টিমকে দেখা হয় ‘তৃতীয় নয়ন’ হিসেবে, যা যেকোনো পুনর্মূল্যায়নে জরুরি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি তাদের শিক্ষা কার্যক্রম এভাবে পুনর্মূল্যায়ন করে থাকে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ডে গবেষণাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেখানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পরবর্তী পাঠ ও পঠনকে সর্বমোট দেওয়া হয় ৩০ শতাংশ, সেখানে সার্বিক গবেষণায় ধরা হয় ৬০ শতাংশ। এই সার্বিক গবেষণার ৩০ শতাংশ দেওয়া হয় গবেষণার পরিমাণ, গবেষণালব্ধ আয় ও গবেষণার ফলপ্রসূতা অর্থাৎ এর প্রয়োগে, যা হতে পারে শিল্পায়ন ও ব্যবসায়। অন্যদিকে গবেষণালব্ধ ফলাফলের আন্তর্জাতিক উদ্ধৃতি (ঈরঃধঃরড়হ), যা স্বীকৃতি হিসেবে পরিগণিত।

গবেষণার সার্বিক মানদণ্ডের ওপর লব্ধ ফলাফলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণালব্ধ ফলাফলের এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির নানা উৎস আছে। তবে ‘গুগল স্কলার সাইটেশন’ হলো সর্বজন স্বীকৃত একটি উৎস। এখানে বলে রাখা ভালো, সব গবেষণাই প্রকাশ করা হয় না। কাজেই সব ধরনের কাজের উদ্ধৃতিও হয় না। সংকীর্ণ আর্থিক লাভের জন্য যেসব গবেষণা হয়, সেগুলো বাদ দিলে জগতের বেশির ভাগ গবেষণাই উদ্ধৃতির আওতায় আসে। সোজা ও সরল ভাষায় বললে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও উদ্ধৃতি হলো গবেষণার মান ও এর প্রভাবের একটি মাপকাঠি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণের মধ্যেই রয়েছে এর আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা ও আবেদন। সঙ্গে দেশীয় শিল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার প্রভাবও গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততায় বিচারকরা যে বিষয়গুলো তাঁদের বিবেচনায় আনেন, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশি ও বিদেশি ছাত্রদের সংখ্যানুপাত এবং দেশি ও বিদেশি শিক্ষকদের সংখ্যানুপাত। অর্থাৎ যথেষ্ট সংখ্যায় বিদেশি ছাত্র ও শিক্ষক থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ডে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। গবেষণা ও ছাত্র আদান-প্রদানে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যথাযথ সম্পর্ক থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে আরো শুভ প্রভাব পড়ে। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি শিল্প ও প্রযুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাও একটি ভালো ভূমিকা রাখে।

শুনেছি, নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানে অর্ডার করলে আপনি অল্প সময়ে আপনার কাঙ্ক্ষিত গবেষণা প্রবন্ধ পেয়ে যাবেন অল্প টাকায়। একইভাবে আপনি পেয়ে যাবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত থিসিস—সেটি হতে পারে আপনার পিএইচডির জন্য। শুনেছি, এক শ্রেণির অসাধু মানুষ চুরিচামারি করে এজাতীয় গর্হিত কাজ করে থাকে। এই নকলবাজদের কারসাজির কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ের মধ্যে দুর্নামের খোরাক জোগায়।

আমাদের দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে সরকারি টাকায় বা জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় যারা চলে, তাদেরও সম্মানজনক কোনো র্যাংকিং নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা আর না-ই বা বললাম। তাদের বেশির ভাগের কোনো অস্তিত্বই নেই র্যাংকিং পদ্ধতির মধ্যে। এ ক্ষেত্রে আমি সার্বিক উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে দায়ী করব একজন করদাতা হিসেবে। প্রথমেই আমি বিনয়ের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দায়বদ্ধতার কথা বলব। কমিশনের সবাই অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন লেজে-গোবরে অবস্থা জেনেও তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? বাইরের জগতের ইউজিসিগুলো প্রয়োজনে কতটা কঠোর হতে পারে, তা কি তাঁদের জানা নেই? বেশি দূরে না-ই বা গেলাম, তাঁরা তো ভারতীয় ইউজিসিকেও অনুসরণ করতে পারেন। কোন কোন বিষয়ে ঘাটতি আছে, তা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আপনারা চিঠি দিন কড়া ভাষায়। যদি না পারেন, তবে অত বড় অফিস রেখে লাভটা কী? সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পদস্থ আরো কিছু প্রশাসকের নিয়োগপদ্ধতি এবং র্যাংকিংয়ের ব্যাপারে আপনাদের সিদ্ধান্তকে দেশের অনেকের মতো আমিও সাধুবাদ জানিয়েছি। এগুলোর বাস্তবায়নে আপনাদের পদক্ষেপের আশায় থাকলাম।

এরপর আসি বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (ইধহমষধফবংয অপপৎবফরঃধঃরড়হ ঈড়ঁহপরষ- ইঅঈ) নামের প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে। নামেই বিভ্রান্তি! বিএসি নামের অর্থ হলো, বাংলাদেশের মানদণ্ড নির্ণয়ের প্রতিষ্ঠান। আপনারা কি সারা বাংলাদেশের মানদণ্ড নির্ণয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন, নাকি একটি বিশেষ প্রকল্পের মানদণ্ড নির্ণয় করার দায়িত্ব নিয়েছেন! আপনাদের নাম হওয়া উচিত ইধহমষধফবংয অপধফবসরপ অপপৎবফরঃধঃরড়হ ঈড়ঁহপরষ (ইঅঅঈ)। আগে আপনারা আপনাদের নাম ঠিক করুন। তবে যে নামেই আপনারা পরিচিত হোন না কেন, আপনাদের কর্মকাণ্ডের কথা মানুষকে বলুন—বাৎসরিক একটি রিপোর্ট বানিয়ে আমলাতন্ত্রের টেবিলের নিচে রেখে দিয়ে করদাতাদের পয়সা নষ্ট করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

একই সঙ্গে আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছেও অনুরোধ রাখছি, দেশের আমজনতা তাদের ছেলেমেয়েকে আপনাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত থাকতে চায়। আপনাদের দেওয়া শিক্ষা সনদের যথার্থ স্বীকৃতি আশা করে। আমার সহকর্মী শিক্ষকদের কাছে আবেদন, পরিস্থিতির উন্নয়নে আপনারা উদ্যোগী হোন। আন্তরিক হোন। নিজের কাজ অসমাপ্ত রেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটাছুটি বন্ধ করুন। অপার সম্ভাবনাময় মেধাবী তরুণদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভার আপনাদের দেওয়া হয়েছে।

তিরিশের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সংগত কারণেই তখন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলত অনেকেই। আজকের মতো সূচক মাপার কোনো আধুনিক পদ্ধতি তখন জানা ছিল না, কিন্তু যেকোনো সূচকেই তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসত। ‘সঠিক মানুষটি সঠিক জায়গায়’ থাকলে আজও আমরা অবশ্যই আমাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারব।