বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের বিকাশে বড় বাধা

6
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের বিকাশে বড় বাধা

কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বিশ্বনেতারা সত্যিকারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন কি না, বহুল আলোচিত এবারের দুবাই কপে সবার চোখ সেদিকে। পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বারবার কার্বন নিঃসরণের প্রধানতম উৎস জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধের তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু বললেই তো হবে না, এর বিকল্পও লাগবে। সেই বিকল্প হলো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ।

দেশে দেশে এর উৎপাদন বাড়ছে। বাড়ছে এর পক্ষে জনসমর্থনও।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশে অনেক নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও করে দেবে।

Pop Ads

জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দ্রুত নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে ঝুঁকতে বিশ্বনেতারা যাতে রাজি হন, তা নিয়ে এবারের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনের শুরু থেকে চলছে তোড়জোড়।

এরই মধ্যে প্রায় ১২০টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ তিন গুণ করার প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষরও করেছে, যাকে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ ও কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে ‘এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’ মনে করছে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ)।
প্রতিশ্রুতি দেওয়া দেশগুলো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ তিন গুণ করার পথে কতটা এগোচ্ছে, তা ধারাবাহিকভাবে খতিয়ে দেখা হবে।

নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ বাড়িয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর এই যে লক্ষ্য, এতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরের দেশগুলোর মধ্যে যারা সমর্থন দিয়েছে, তাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো বাংলাদেশও আছে বলে জাপানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিকেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সমর্থনকারী দেশগুলোর জন্য অভ্যন্তরীণভাবে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ তিন গুণ করার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও প্রতিশ্রুতির লক্ষ্য অর্জনে দেশগুলোকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে বিস্তৃত পদক্ষেপ নিতে হবে।

কয়লানির্ভর বড় দুই দেশ ভারত ও চীন এই প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করেনি। তবে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তাদের ভূমিকা কী থাকবে সে-সংক্রান্ত পরিকল্পনা তারা আগেই ঘোষণা করেছে।

২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ তিন গুণ করার অর্থ হচ্ছে, ওই বছর বিশ্বে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের পরিমাণ হতে হবে ন্যূনতম ১১ হাজার গিগাওয়াট। ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্বকে আগামী সাত বছরের মধ্যে আরো প্রায় সাত হাজার ৮০০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ গ্রিডে যোগ করতে হবে। অতিরিক্ত এই বিদ্যুতের বেশিরভাগই হবে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ।

সে ক্ষেত্রে বছর সাতেকের মধ্যে চার হাজার গিগাওয়াটের বেশি সৌরবিদ্যুৎ এবং দুই হাজার ৬০০ গিগাওয়াটের বেশি বায়ুবিদ্যুৎ লাগবে, যা ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে থাকা এই দুই নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের যথাক্রমে পাঁচ ও চার গুণ।

যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, এখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী তা ‘পূরণযোগ্য’ বলে ক্লাইমেট থিংকট্যাংক এম্বারের নভেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ৫৭টি দেশের কাছেই বিশ্বের মোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ৯০ শতাংশ; দেশগুলোর জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা পর্যালোচনা করে এম্বার দেখেছে, বিশ্ব এখন যে পথে রয়েছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ দ্বিগুণ করে ফেলবে। এটাই তিন গুণ করতে প্রতিবছর গড়ে শুধু ১৭ শতাংশ করে বাড়ালেই চলবে।

এম্বারের প্রতিবেদন বলছে, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শিল্পোন্নত এবং মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করা দেশগুলোকে নবায়নযোগ্য শক্তি তিন গুণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনকার চেয়ে ‘বেশি কিছু’ করতে হবে।

চীন ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের এখনকার সক্ষমতা দ্বিগুণ করে ফেলার পথে রয়েছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া আর ফিলিপাইনের লক্ষ্য হচ্ছে একই বছরের মধ্যে তাদের মোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ এখনকার তিন গুণের বেশি করে ফেলা।

বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের পক্ষে অবশ্য সহজেই তিন গুণের বেশি করে ফেলা সম্ভব, কেননা তাদের এখনকার নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ‘অনেক কম’।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাড়ে ৪ শতাংশের মতো। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি তিন গুণ করলে তা পৌঁছবে ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ বাংলাদেশ সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য থেকে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হলে বাংলাদেশকে কপ২৮-এর প্রতিশ্রুতি ছাড়িয়ে আরো বেশি পরিমাণে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকতে হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকলে শুধু যে কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশদূষণ কমবে, তা-ই নয়, আমাদের আমদানি ব্যয়ের বড় অংশ যায় জ্বালানির পেছনে, সেই ব্যয়ও বাঁচবে।’

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাকরি তো বাড়বেই, এখানে নারীর সুযোগও বাড়বে। জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে নারীদের তো দেখাই যেত না। এর বাইরে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাও বাড়াতে পারে।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিসিসের লিড এনার্জি অ্যানালিস্ট ফর বাংলাদেশ শফিকুল আলম বলছেন, ‘নীতি যেটুকু আছে, সেটা বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতাও বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের বিকাশে বড় বাধা।’