বাংলা ভাষায় আরবি রচনাবলির অনুবাদ চলছে

18
বাংলা ভাষায় আরবি রচনাবলির অনুবাদ চলছে

পৃথিবীতে বহু ভাষা আছে। সব ভাষা মহান আল্লাহর দান। তিনিই মানুষকে কথা বলা শিখিয়েছেন। ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা তাঁর অন্যতম নিদর্শন।

ভাষা কোনো ধর্মের প্রতিনিধিত্ব না করলেও ধর্ম তার নির্দেশনাবলি প্রকাশ এবং উপাসনার মাধ্যম হিসেবে একটি ভাষাকে গ্রহণ করে। সেটি সে ধর্মের দাপ্তরিক ভাষা। ইসলাম ধর্মের দাপ্তরিক ভাষা আরবি। এই ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।

Pop Ads

মহানবী (সা.) আরবি ভাষী হওয়ায় তাঁর কথা, কাজ ও সম্মতি বা হাদিস আরবি ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। আরবি মুসলমানদের ধর্মের ভাষা এবং ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামী সাহিত্যে আরবি একক ভাষা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আরবি ভাষা ও সাহিত্য আধুনিক সব শাখায় সমানভাবে বিচরণ করছে।

এ ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য ও ধর্মবিষয়ক নানা ধরনের গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে আরবি ভাষায় লিখিত ইন্টারনেটভিত্তিক নানা তথ্য। বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে এ বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আরবি-বাংলা অনুবাদ সাহিত্য ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। অনুবাদ বিভিন্ন ভাষার মানুষের মধ্যে চিন্তা, আদর্শ ও সংস্কৃতির মিলনের মৌলিক মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। অনুবাদের মাধ্যমেই পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পকলা সম্পর্কে সাধারণ পাঠক জ্ঞান লাভ করে।

অনুবাদশিল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের জনগণ পরস্পরের মধ্যে তাদের অভিজ্ঞতার অংশীদার হতে পারে এবং কোনো জাতির মধ্যে অনুপস্থিত কোনো বিষয়ে অন্য জাতির অনুকরণের মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারে। সব ভাষায়ই অনুবাদের একটি বিশেষ ঐতিহ্য আছে। ইসলামের পরিধি সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম পর্যায়ে কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান আরবি থেকে অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বঙ্গদেশে মুসলমানদের আগমনের সময় থেকে এে দশের মানুষের সঙ্গে আরব ও আরবি ভাষার সখ্য গড়ে উঠেছে। সেই ধারাবাহিকতায় প্রয়োজনীয় আরবি রচনাবলির বাংলা অনুবাদ হয়েছে, বিশেষ করে কোরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকহসহ অসংখ্য ধর্মীয় বই-পুস্তকের বাংলা অনুবাদ হয়েছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ‘অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ’ নামের একটি বিভাগ রয়েছে। একজন পরিচালক এ বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থাকেন। কোরআনুল কারিমের অনুবাদ, তাফসির, হাদিস গ্রন্থ ও ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে বিভিন্ন ভাষায় লিখিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থাদি অনুবাদ ও সংকলন করা এ বিভাগের কাজ। এ বিভাগের মাধ্যমে সিহাহ সিত্তাহর পূর্ণাঙ্গ সেট, যেমন : বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ এবং মুয়াত্তা ইমাম মালেক ও মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, তাজরিদুস সিহাহ ইত্যাদি হাদিস গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তা ছাড়া এ বিভাগ থেকে আরবি ভাষায় রচিত ‘তাফসিরে জালালাইন’, ‘তাফসিরে ইবনে কাছির’, ‘তাফসিরে তাবারি’, ‘তাফসিরে মাজেদি’, ‘তাফসিরে মাযহারি’, ‘তাফসিরে ইবনে আব্বাস’, ‘ফতোয়ায়ে আলমগীরী’, ‘আল-হিদায়া’, ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’, ‘সিরাতে ইবনে ইসহাক’, ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’, ‘আসাহুস সিয়ার’ এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্য মতে, এ পর্যন্ত এই বিভাগ থেকে মোট ৩৮৮টি অনূদিত পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভালের জন্য একক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চতর শিক্ষার পাশাপাশি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক চাহিদার যথার্থতা নিরূপণপূর্বক অর্থায়ন করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। কমিশনের আরেকটি অন্যতম কাজ হলো উচ্চশিক্ষা স্তরে মৌলিক পাঠ্যপুস্তক, রেফারেন্স বই, অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ এবং অন্যান্য প্রকাশনায় আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। কমিশনের রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগ এ দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রকাশনা তালিকার তথ্যমতে, এ বিভাগ আরবি সাহিত্যবিষয়ক তিনটি গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করেছে। (১) সপ্ত ঝুলন্ত গীতিকা (সাবউল মুয়াল্লাকাত আরবি কবিতার অনুবাদ), (২) যুকাক আল-মিদাক (আরবি সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী নাজিব মাহফুযের আরবি উপন্যাসের অনুবাদ) ও (৩) মুস্তফা কামিলের আরবি নাটক ফাতহুল আন্দালুস (মুস্তফা কামিল রচিত আরবি নাটক ফাতহুল আন্দালুসের অনুবাদ)।

ব্যক্তিমালিকানাধীন ইসলামী প্রকাশনীগুলো প্রতিনিয়ত আরবি ভাষায় রচিত ধর্মীয় বই-পুস্তকের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে। বাংলাদেশে ইসলামী সাহিত্যচর্চায় মৌলিক লেখকের চেয়ে অনুবাদকের সংখ্যা বেশি। প্রকাশকরাও অনূদিত গ্রন্থ প্রকাশে বেশি আগ্রহ দেখান। এ ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগেও কিছু আলেম আরবি ভাষায় রচিত বই-পুস্তকের বাংলা অনুবাদ করেন এবং প্রকাশ করে থাকেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ রয়েছে। সেখানে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের পাঠদান চালু রয়েছে। ফলে এসব বিভাগের অনেক শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আরবি সাহিত্যবিষয়ক রচনাবলির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ হয়।

পরিশেষে বলা যায়, পৃথিবীর অপরিবর্তিত ও কোরআন-সুন্নাহর প্রভাবে প্রভাবিত একমাত্র ভাষা আরবি। ইসলামের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বের চাহিদা পূরণেও যথার্থ ভূমিকার কারণে আরবি ভাষার অপরিহার্যতা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে আরবি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্যের বিশালতা, সমৃদ্ধি ও প্রকৃতি জানতে আরবি ভাষা ও সাহিত্য চর্চা যৌক্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের অনুবাদ এ চর্চার মৌলিক দাবি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়