মধুর মধুতে অভিজ্ঞতা

14
মধুর মধুতে অভিজ্ঞতা

গত বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক উদ্যমী যুবকের খবর পেলাম। মৌমাছি ঘিরে তিনি রচনা করেছেন অ্যাডভেঞ্চারে ভরা এক জীবন। সেই যুবকের নাম মুয়াজ্জিন হোসেন।

শেষ ডিসেম্বরের এক ভোরে মানিকগঞ্জের সিংগাইর রওনা হই মুয়াজ্জিন হোসেনের কর্মকাণ্ড দেখতে।

Pop Ads

প্রান্তও তখন কুয়াশায় ঢাকা। ক্রমে সকালের মিষ্টি রোদ উঁকি দিল। নির্ধারিত গন্তব্যে এসে চোখে পড়ল আদিগন্ত হলুদ সরষের মাঠ। একটি ক্ষেতের এক কোণে তাঁবু টানানো! আর তাঁবুর কাছাকাছি অনেক মৌমাছির বাক্স।

পাশেই সকালের মধু ভাঙার কাজ করছিলেন মুয়াজ্জিন। বয়স ত্রিশ অতিক্রম করেছে বলে মনে হয়নি।
মুয়াজ্জিন হোসেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ করেছেন। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি কিংবা করপোরেট অফিসে কাজকর্ম করার স্বপ্ন দেখেন।

কিন্তু মুয়াজ্জিনের স্বপ্নটা ছিল ভিন্ন রকম। বলছিলেন মুয়াজ্জিন, ‘এমবিএ পড়ার সময় ইউটিউবে আপনার একটা ভিডিও দেখলাম মৌমাছির চাষ নিয়ে। দেখে খুব আগ্রহ হলো। মৌমাছি চাষ বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। একদিন বাসায় জানালাম, মৌমাছি চাষ করতে চাই।

বাবা শুনে রেগে গেলেন। এত পড়াশোনা করে শেষে মৌচাষি! একদিন বাসা থেকে পালিয়ে গেলাম।’
ঘর পালানো মুয়াজ্জিন বাগেরহাটে এক মৌচাষির কাছে গিয়ে উঠলেন। জানালেন, মৌচাষ শিখতে চান। সেই মৌচাষি রাজি হলেও বললেন, কোনো বেতন দিতে পারবেন না। পেটেভাতে কাজ করতে চাইলে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারি। মুয়াজ্জিন তাতেই রাজি। দুই মাস সেখানে থেকে কাজ শিখলেন। একদিন একগাদা মৌমাছির কামড় খেয়ে চেহারা ফুলে ঢোল। ১০-১২ দিন বাইরে বের হতে পারেননি। তৃতীয় মাসে মৌচাষি জানালেন তাঁর শেখা শেষ। বিদায়ের সময় তিনি মুয়াজ্জিনকে চারটি বাক্স উপহার দিলেন।

গুরুর কাছ থেকে পাওয়া উপহারের চারটি বাক্স দিয়ে শুরু করা মুয়াজ্জিনের এখন ৬৪টি বাক্স। ছয়-সাত বছর ধরে মৌচাষ করছেন তিনি। মৌমাছির জীবনচক্রের বিভিন্ন অংশের পাঠও তাঁকে বেশ আকৃষ্ট করে। কাঠের ফ্রেম থেকে মধু আহরণ করতে করতে মুয়াজ্জিন বলছিলেন নানা অভিজ্ঞতার কথা। শিখেছেন মৌমাছি কখনো নষ্ট ফুল থেকে মধু আহরণ করে না। মূলত পরিষ্কার ও অব্যবহৃত ফুল থেকেই মধুর উপাদান সংগ্রহ করে থাকে। পড়াশোনা করে পেয়েছেন, আধা কেজি মধুর জন্য ৬০০ মৌমাছিকে প্রায় ২০ লাখ ফুলে ভ্রমণ করতে হয়। একটি কর্মী মৌমাছিকে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়! তাঁর মতে, কলোনিতে মৌমাছিদের সুশৃঙ্খল আচরণ ও কর্মকাণ্ড মানুষের জন্যও শিক্ষণীয় হতে পারে।

আমার জানা মতে, সুন্দরবনের মৌয়ালসহ সারা দেশে মধু সংগ্রহের পেশায় যুক্ত রয়েছেন প্রায় ২৫ হাজার মধু চাষি। তাঁদের হাতে পাল্টে গেছে মধু আহরণের হাজার বছরের পুরনো ধ্যানধারণা। মধু চাষ বা আহরণ এখন একটি শিল্প। দেশে ৩০ হাজার টন মধুর চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার টন। এই মধু সাধারণত কালিজিরা, ধনে, লিচু ও সরষে ফুল থেকে উৎপাদিত হয়ে থাকে। তবে সরষে ফুলের মধু সংগ্রহের ব্যাপারটিই বেশি দৃশ্যমান। এ ছাড়া দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনে সারা বছরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মধু আহরণ হয়ে থাকে। দিন দিন দেশে মধু আহরণের পরিমাণ বাড়ছে।

গত কয়েক বছরে দেশের অনেক শিক্ষিত তরুণ বা অন্য উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষে নেমেছেন। মুয়াজ্জিনের সর্বমোট ৬৪টি বক্স বা কলোনিতে সারা বছরে খরচ হয় চার লাখ টাকার মতো। আর তা থেকে ভালো একটা আয় আসে তাঁর। তুলনামূলকভাবে অল্প পুঁজিতে এটাই তাঁর কাছে অনেক বড় পাওয়া। মধু আহরণের জন্য দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোটাও উপভোগ করেন তিনি।