আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

41
আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

দেশের বাজারে রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে আলু। যা সরকার নির্ধারিত দামের থেকে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৭০ টাকা প্রতিকেজি। বাজার নিয়ন্ত্রণে তাই এবার আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে পেঁয়াজের বাজারের সংকট ক্রমেই বাড়ছে। মাত্র দুই-দিনের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৫০ টাকা। যা সরকার নির্ধারিত দামের থেকে প্রায় আড়াই গুণ বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই দাম আরও বাড়তে পারে।

এদিকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় সরবরাহ বাড়াতে এবং দাম স্থিতিশীল রাখতে আলু আমদানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

Pop Ads

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ায় মাত্র দুই দিনেই পণ্যটির বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ দেশীয় উৎপাদনে জোগান দেওয়া আলুর বাজার বৃদ্ধির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। এদিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমদানিকৃত আলু বাজারে সরবরাহ না করা গেলে দেশীয় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, নভেম্বরের শেষেই বাজারে নতুন আলুর আসতে পারে। তখন যদি আমদানি আলু বাজারে আসে তাহলে কৃষক ন্যয্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

এদিকে, আগ্রহী আমদানিকারকদের অনুমতি নেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমদানি বাড়িয়ে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রখার পরও বেশিরভাগ পণ্যের দামই বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানির অনুমতি পাওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা আমদানি না করায় বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখা যায় না। সর্বশেষ ডিম আমদানি অনুমতি দেওয়ার পর এক মাস পার হলেও এখনো বাজারে এর সরবরাহ শুরু হয়নি, ফলে আলু আমদানির প্রভাব নিয়েও শঙ্কা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীসহ বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী এবার প্রতিকেজি আলুর উৎপাদন খরচ প্রায় ১১ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে গত দুই মাস ধরে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা সর্বশেষ ৩০ অক্টোবর বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা কেজি দরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যস্বত্বভোগীরাই ধাপে ধাপে কৃত্তিম সংকট তৈরি করে আলুর দাম বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে সরকারের দাবি, চলতি বছর চাহিদার বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে দেশে। তাদের হিসাবে এক কোটি ১২ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। যা মোট চাহিদার থেকে বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে আলুর চাহিদা ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ১ দশমিক ১২ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়। তবে কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণে ঘাটতি এবং বীজের জন্য আলু প্রয়োজন হওয়ায় আরও আলু উৎপাদন প্রয়োজন। আলুর উৎপাদন কম হওয়া নিয়ে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরকার এ বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের।

কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, যদিও সরকার এ বছর এক কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদনের কথা জানিয়েছে, বাস্তবে ৮০ লাখ টনের বেশি আলু উৎপাদন হয়নি। ফলে এক ধরনের সংকট রয়েছে।

এর আগে গত ৭ অক্টোবর অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আলু আমদানির পরিকল্পনার বিপক্ষে ছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। ফলে সে সময় ব্যবসায়ীদের আলু আমদানির অনুমতি দেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু নির্ধারিত দামে বাজারে আলু ও পেঁয়াজের দাম কার্যকর না হওয়ায় আলু আমদানি করা হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, ‘দেশের গোটা বাজারব্যবস্থা তৈরি হয়েছে এমনভাবে, যেখানে কৃষক ও ভোক্তার কোনো মূল্য নেই। ১০ টাকায় আলু বিক্রি করে কৃষক লোকসান গুণলেও বাজারে তা ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যার পুরো ব্যয় বহন করে সাধারণ ভোক্তা। সরকারের উচিত, কেন দাম বাড়ছে, কারা বাড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তা না করে চাহিদার শত ভাগ উৎপাদন সক্ষম এই খাতে আমদানি কতখানি যৌক্তিক, তা আমি বুঝি না।’ তিনি বলেন, কৃষক ঋণ করে সার কিনছে, ‘জমিতে সেচ এবং শ্রম দিচ্ছে আবার একটু বৃষ্টিতেই ফসল নষ্ট হচ্ছে। তার উৎপাদন ব্যয় কয়েক বেড়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে সে দাম পায় না। এমন অবস্থায় কিছু দিনের মধ্যেই বাজারে নতুন আলু আসবে। তখন যদি আমদানি করা হয়, তাহলে কৃষক বাঁচবে না। সরকারের উচিত, সব কিছু চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।’

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলুর জন্য স্টোরেজ সংকট রয়েছে। ফলে দাম না পেলেও কৃষক বাধ্য হয়ে কম দামে আলু বিক্রি করে। দেখা যায়, জুলাইয়ের মধ্যেই কৃষকের আলু শেষ হয়ে যায়। এরপর সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বর বাজারে কোল্ড স্টোরেজের আলুর সরবরাহ শুরু হয় এবং বাজারে দাম বাড়তে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সিন্ডিকেট সরবরাহ বাড়িয়ে-কমিয়ে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি : সোমবার খাতুনগঞ্জের পাইকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা তিন দিন আগেও যথাক্রমে ৮০ ও ৯০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। ফলে খুচরা বাজারে হু হু করে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। এদিন চট্টগ্রামে বিভিন্ন বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ১২০ ও দেশি পেঁয়াজ ১৪০ টাকায় বিকিকিনি হচ্ছে। এদিকে রাজধানীর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পেঁয়াজের দাম যে হারে বাড়ছে, এতে এ সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজের দাম ২০০ ছাড়াতে পারে।

খাতুনগঞ্জ কাঁচাপণ্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিচ মিয়া বলেন, পেঁয়াজ আমদানির বড় অংশ হয় ভারত থেকে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অব ফরেন ট্রেড বা বৈদেশিক বাণিজ্য-বিষয়ক মহাপরিচালকের কার্যালয় শনিবার প্রতি টন পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ৮০০ ডলার নির্ধারণ করেছে।

এর আগে, গত আগস্টে পেঁয়াজের অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়াতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজের ওপর ৪০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করেছিল ভারত। ফলে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে এবং দেশে পেঁয়াজের বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।

পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জেএম ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী বলেন, ভারত সরকার নতুন করে পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার ফলে দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। বর্তমান ডলার মূল্যে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, এতে দাম আরও বাড়তে পারে।

অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকা এবং আলু ৩৫-৩৬ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সরকারি সংস্থা মাঠে নামিয়েও নির্ধারিত সেই দাম বাজারে কার্যকর করা যায়নি। উল্টো দেড় মাস পর দাম এখন আরও বেড়েছে। বাজারে বেঁধে দেওয়া দামের দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ ও আলু।