জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু! -শিবব্রত গুহ

শিবব্রত গুহ

সুপ্রভাত বগুড়া (স্বাধীন মতামত): ” এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। ” – উপরিউক্ত বাণীটি হল বাঙালী জাতির গর্ব, স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ, বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম ছিল শেখ লুৎফর রহমান এবং মায়ের নাম ছিল সায়েরা খাতুন । বঙ্গবন্ধু ৬ ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন তৃতীয়।

তাঁর বাবা ছিলেন, গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার। বঙ্গবন্ধুর বড় বোনের নাম হল ফাতেহা বেগম, মেজ বোনের নাম হল আছিয়া বেগম, সেজ বোনের নাম হল হেলেন, ছোট বোনের নাম হল লাইলী এবং ছোট ভাইয়ের নাম হল শেখ আবু নাসের। বঙ্গবন্ধু ১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে, শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। ১৯২৯ সালে, ৯ বছর বয়সে, তিনি ভর্তি হয়েছিলেন গোপালগঞ্জ পাবলিক বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি মোট ৫ বছর পড়াশোনা করেন। এরপরে, তিনি, ১৯৩৭ সালে, গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন বিদ্যালয়ে, সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে, তিনি, গোপালগঞ্জ মিশনারি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।

Pop Ads

১৯৪৪ সালে, বঙ্গবন্ধু, এইচ.এস.সি এবং বি.এ.পাশ করেছিলেন ১৯৪৬ সালে। তিনি ১৯৩৮
সালে, বেগম ফজিলাতুন্নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মাত্র ১৮ বছর বয়সে। তাঁদের মেয়ে দুজন – শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তিন ছেলে – শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। এই ২০২০ সাল হল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। এই জন্মশতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এপার বাংলা ও ওপার বাংলা – দুই বাংলার তরফ থেকেই প্রচেষ্টার নেই কোন খামতি। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সবসময় মানবিকতায়। তিনি মানুষকে বাসতেন ভালো। অল্পবয়স থেকেই, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটে।

১৯৪০ সালে, তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেছিলেন। পরে, আবার, ১৯৪৩ সালে, তিনি যুক্ত হন উদারপন্থী ও প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। এসময় তিনি সংস্পর্শে এসেছিলেন হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে, বঙ্গবন্ধু এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে, বাংলা ভাষার প্রশ্নে, তাঁর নেতৃত্বেই প্রথম প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছিল। যার চূড়ান্ত পরিণতি হল ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী। যা আজ সারা পৃথিবীতে পালিত হয় ” আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ” হিসাবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর মাতৃভাষা বাংলাভাষাকে আজীবন খুব ভালোবেসেছিলেন। বাংলাভাষাতে কথা বলে, তিনি অসম্ভব তৃপ্তি পেতেন। বাংলাভাষা ছিল তাঁর কাছে গর্বের। তাঁর বাণী গুলো সত্যিই অসাধারণ। তাঁর বাণী পাঠ করলে মনে জাগে আত্মবিশ্বাস।

এবার তাঁর কয়েকটা বাণী আপনাদের সামনে তুলে ধরছি : 

#” যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায়
বেশী হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য
কথা আমরা মেনে নেবো।”

#” ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে
বাংলাদেশ স্বাধীন।

#” আমি বাংলাদেশের জনগনকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছো, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো।

# ” পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। “

# ” যার মনের মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা সে
হলো বন্য জীবের সমতূল্য।”

# ” জনগণকে ছাড়া, জনগণকে সংঘবদ্ধ না করে,
জনগণকে আন্দোলনমুখী না করে এবং পরিস্কার
আদর্শ সামনে না রেখে কোনোরকম গণ আন্দোলন হতে পারেনা। “

# ” ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না।
দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে।”

# ” অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়। “

বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ছিল অতুলনীয়। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বাঙালী জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা দেওয়ার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করার। একজন্য, তিনি করেছিলেন মরণপণ সংগ্রাম। বাঙালী যে ভীরু – কাপুরুষ নয়, বাঙালী বীর, বাঙালী বীরের মতো বাঁচতে জানে আবার, জানে মরতেও – এই সত্য তিনি নিজের জীবন দিয়ে করেছিলেন প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু কখনো কোন পরিস্থিতিতে, কোনদিনও পাননি ভয়। কারণ, তিনি জানতেন, ভয়কে কি করে জয় করতে হয়? তাই, তিনি পারতেন পাকিস্তানের খান সেনাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে। তাঁর মনে সদাজাগ্রত ছিল স্বাধীনতার উদগ্র বাসনা। স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে, তিনি বাঙালী জাতিকে করেছিলেন ঐক্যবদ্ধ।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল আগুনঝরানো। তাঁর ভাষণ মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলতো। তাঁর ভাষণ শুনলে, মানুষেরা উদ্ধুদ্ধ হতেন। তিনি পারতেন , অসম্ভবকে সম্ভব করতে। এরকমই একটা দিনের কথা বলি। দিনটা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক স্মরণীয় দিন। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের বীজ এদিন থেকেই বপন হয়েছিল।

দিনটা ছিল ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ। ওইদিন, রেসকোর্সের মাঠে, ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওইদিন রেসকোর্সের মাঠ ছিল জনসমুদ্র। তাঁর এই ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক। এই  তিহাসিক ভাষণে, তিনি বাঙালী জাতিকে করেছিলেন আহ্বান পরাধীনতার শৃঙ্খল চিরকালের মতো মুক্ত করার। তিনি বলেছিলেন, ” রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।” শত্রুর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলেছিলেন। ইয়াহিয়ার রক্তচক্ষুকে অবজ্ঞা করে, বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে দিয়েছিলেন সাড়া। যা ছিল সত্যিই অভূতপূর্ব।

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বে, বাঙালী জাতি শেষ অবধি, পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ। পরাধীনতার জ্বালা তাদের জীবন থেকে হয়েছিল দূরীভূত। তারা পেয়েছিল স্বাধীনতা। যার জন্য, তারা অনেক অনেক দিন ধরে করেছিল অপেক্ষা।এ স্বাধীনতার আনন্দ ভাষায় যাবে না প্রকাশ করা। তবে, এই স্বাধীনতা আসেনি সহজে। অনেক অনেক রক্তের বিনিময়ে এসেছিল এই স্বাধীনতা। যার জন্য, অনেক বাঙালী মায়ের কোল হয়েছে খালি, অনেক বীর বাঙালী নারী – পুরুষ হয়েছেন শহীদ। অনেক চোখের জল ঝরে গেছে নিরন্তর, বহু মানুষের বুকফাটা আর্তনাদও রয়েছে এই স্বাধীনতার পেছনে। পথে বাধা ছিল প্রচুর, কিন্তু, বীর বাঙালীরা সেই বাধা পেরিয়ে সব অসম্ভবকে করেছে সম্ভব। আর, তা সবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বে। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে, পৃথিবীর বুকে জন্ম হয়েছিল একটি নতুন দেশের, যার নাম বাংলাদেশ।

এই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হল বাংলা ভাষা। এই পৃথিবীতে একমাত্র দেশ হল বাংলাদেশ, যে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হল বাংলা, বাংলা শুধুই বাংলা। এই বাংলা ভাষা বড়ই মিষ্টি। এই ভাষায় কথা বললে বাঙালী জাতির মনপ্রাণ যায় জুড়িয়ে। বাঙালীরা এই ভাষায় কথা বলে, এই ভাষায় গায় গান। এককথায়, বলতে গেলে, বাঙালী জাতির প্রাণের ভাষা হল বাংলাভাষা। যে ভাষা, বাঙালীকে দেয় বাঁচার অনুপ্রেরণা। সুজলা, সুফলা শস্য – শ্যামলা বাংলাদেশের গর্ব হলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা সবাই জানি, যে, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনা হলেন বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে, বাংলাদেশ আজ চলেছে এগিয়ে দ্রুতগতিতে। ১৯৭৫ সালের, ১৫ ই আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক শোকের দিন। এই দিন, বাংলাদেশের বুকে, যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছিল, তা সম্ভিত করে দেয় বিশ্ববাসীকে। মহান বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সাথে, এইদিন, যা যা ঘটেছিল, তা লজ্জা দেয়, মানবতাকে।

এবার সেই কাহিনী আপনাদের সামনে বলবো। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট, ভোরে, বঙ্গবন্ধুর শত্রু, কিছু স্বার্থপর, নরপিশাচ, শয়তানের দল, এই জঘন্য কাণ্ড ঘটায়। এদের একদল মেজর হুদার অধীনস্হ ছিল। বেঙ্গল লেন্সারের ফার্স্ট আর্মড ডিভিশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে চালিয়েছিল হামলা। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত একটি বই লিখেছিলেন। তার নাম হল ” মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা “। এই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন যে, মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বর্ণনা সবসময়ে রহস্যে ঘনীভূত থাকবে। মুজিবের বাসভবন রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি প্লাটুন প্রতিরোধের কোন চেষ্টা করে না। মুজিবের পুত্র , শেখ কামালকে, নিচতলার অর্ভ্যথনা এলাকায় গুলি করা হয়। মুজিবকে পদত্যাগ করা ও তাঁকে এবিষয়ে বিবেচনা করার জন্য বলা হয়।

মুজিব সামরিক বাহিনীর প্রধান, কর্নেল জামিলকে, টেলিফোন করে সাহায্য চান। জামিল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সৈন্যদের সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলে তাঁকে সেখানে গুলি করে মারা হয়। মুজিবকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুজিবের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাঁকে উপরের তলায় হত্যা করা হয়। মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসের, দুইজন চাকর। তাঁদের হত্যা করা হয় শৌচাগারে। শেখ জামাল, ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেল এবং মুজিবের দুই পুত্রবধূকেও হত্যা করা হয়৷ সেসময়, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। তাই, সৌভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাহিনী মনকে খুব, খুব ভারাক্রান্ত করে তোলে। যে মহান মানুষটি, সারাজীবন ধরে দেশ ও দেশবাসীর জন্য কত আত্মত্যাগ করলেন, কত কষ্ট সহ্য করলেন, যাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হল, সর্বোপরি, বাঙালী জাতিকে যিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে চিরকালের মতো মুক্তি দিলেন, তাঁকে ও তাঁর
পরিবারকে শেষপর্যন্ত এইভাবে করা হল হত্যা! এযে ভাবনারো অতীত।

এই লেখাটা শেষ করছি, জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার একটি স্বরচিত কবিতা দিয়ে ঃ

হে বঙ্গবন্ধু,
জন্মশতবর্ষে,
তোমার চরণে নিবেদন করি,
আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা,
তোমার হয়নি যে মৃত্যু,
মৃত্যুকে তুমি করেছো যে জয়,
তুমি করেছো লাভ অমরত্ব
আর চিরকাল তুমি অমর হয়েই থাকবে,
বাঙালী জাতির হৃদয়ে,
বাঙালী জাতির হৃদয়ে,
বাঙালী জাতিরই হৃদয়ে।

( তথ্য সংগৃহীত ) শিবব্রত গুহ
৩/এ, কে.পি.রায়.লেন,
পোস্ট অফিস – হালতু,
থানা – গড়ফা,
কোলকাতা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here