দেশের বর্তমান রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক : বাংলাদেশ ব্যাংক

66

কোভিড-১৯ মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং উন্নত বিশ্বের নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিকূলতার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এতে দেশের বৈদেশিক খাত অনেকটা চাপের মুখে পড়েছে। তবু অর্থনীতির প্রকৃত খাতের প্রায় সব সূচক স্বস্তিদায়ক রয়েছে। মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারি নীতি সহায়তায় গ্রামীণ অর্থনীতি বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পরিস্থিতি ভালো রয়েছে। পাশাপাশি শিল্পোৎপাদন, যা শিল্প উৎপাদন সূচকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাতে ভালো প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের উৎপাদনমুখী ও উন্নয়নমুখী ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনীতির গতিশীলতাকে চলমান রাখার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে।

Pop Ads

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সন্তোষজনক থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন অবকাঠামোগত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ শিল্প ও সেবা খাতে চলমান ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশের বেশি হবে।

রাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের বৈদেশিক খাত বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বিনিময় হারের ওপর জোরালো চাপ পরিলক্ষিত হয়। বৈশ্বিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন, অভ্যন্তরীণ মৌসুমী আবহাওয়ার প্রতিকূল প্রভাব এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়াসহ সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। এতে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়।

তাতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ বিনিময় হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ প্রশমনে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে নীতি সুদহারের বৃদ্ধি, আমানত ও ব্যাংক ঋণের সুদহারে সীমা তুলে তা বাজারমুখী করা, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে লোন না দেয়া, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেয়া, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হার বাজারমুখী করা, আমদানি মূল্য যাচাইসহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজার তদারকি বৃদ্ধি করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি ব্যয় মিটানোর ব্যবস্থা নেয়া উল্লেখযোগ্য।

এসব পদক্ষেপে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর বিদ্যমান চাপ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্য গত বছরের প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি কাটিয়ে উঠেছে। সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মত উদ্বৃত্ত হয়েছে। তবে ফাইন্যান্সিয়াল একাউন্টের আগের স্বস্তিদায়ক উদ্বৃত্ত অবস্থা থেকে ঘাটতি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যে কারণে সার্বিক বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে এখনও কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। আশা করা যায়, বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে শিগগিরই স্বস্তিদায়ক অবস্থা ফিরে আসবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণসহ মুদ্রা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনয়নে যা আরও সহায়ক হবে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী ও কার্যকর নীতি গ্রহণে বর্তমানে বিদ্যমান মুদ্রা বিনিময় হার প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার সূচকের সঙ্গে অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ রয়েছে। এক্ষেত্রে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি নীতি সুদহার আর না বাড়ায় কিংবা হ্রাস করে; তাহলে দেশের বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনয়নে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান রিজার্ভ আইএমএফের বিপিএম-৬ অনুযায়ী, প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো আছে। এ দিয়ে প্রায় ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মিটানো সম্ভব। এটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যেকোনও অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং এর প্রত্যাশাকে ধরে রাখার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় সংকোচন করেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির অভিঘাত নিরসনকল্পে সামাজিক নিরাপত্তা জালের (যেমন, ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ড, ট্রাক সেল ইত্যাদি) আওতার ব্যপ্তি বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সংকোচনমূলক যুগপৎ নীতি পদক্ষেপ এবং উৎপাদন ও বিনিয়োগ সহায়ক নীতির ফলে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির আশু উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।

আগামী জানুয়ারির মধ্যে দেশের মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ শতাংশে এবং জুন শেষ নাগাদ ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ব্যাপারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আসছে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন হওয়ার পর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি হবে। অর্থবছরের শেষ নাগাদ দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে আর্থিক ও রাজস্ব খাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে শিগগিরই দেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির বৈদেশিক খাতে স্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা ফিরে আসবে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ভূ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আগামীতে বাংলাদেশ আরও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।