দেশে এবার আম-লিচুর ফলনে ধস নামার শঙ্কা

3
দেশে এবার আম-লিচুর ফলনে ধস নামার শঙ্কা

দেশে চলমান তীব্র দাবদাহের প্রভাবে মৌসুমি ফলের ফলনে বড় রকমের ধস নামার শঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে আম-লিচুর ফলনে ভাটা পড়ার ভয় করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের বড় বড় আমের বাগান থেকে শুরু করে পারিবারিক পর্যায়ে আম গাছে যে পরিমাণে মুকুল ধরেছে তা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক কম। ধারণা করা হচ্ছে, এবার আমের ফলনে বড় রকমের ধস নামতে পারে।

শুধু আমের ফলন না, ফলন বিপর্যয় ঘটছে লিচুরও। লিচুর দানা শীষসহ ঝড়ে পড়ার কারণে চাষীরা ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।

Pop Ads

সাতক্ষীরার আম চাষীরা সময় সংবাদকে জানিয়েছেন, প্রতিবছর যে পরিমাণে আমের মুকুল ধরে এ বছর তার তুলনায় মুকুল অনেক কম ধরেছে। বিশেষ করে এই দাবদাহে অনেক গাছের আম মুকুলে ঝরে যাচ্ছে।

একই অবস্থা লিচুতেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব এরইমধ্যে ফলের ফলনের ওপর পড়তে শুরু করেছে। এবার গ্রীষ্মে মৌসুমি ফলের ফলন আশানুরূপ হবে না বলে শঙ্কা করছেন তারা।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোবোটানি বিভাগের চেয়ারম্যান ইলিয়াস হোসেন সময় সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে যে দাবদাহ চলছে তা কোনো ফসলের জন্যই ভালো না। বিশেষ করে আমের মুকুলের পুরুষ রেণু এই গরমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে আমের ফলন কম হবে।’

ইলিয়াস বলেন,
যেসব ফসল ফুল বা মুকুলকেন্দ্রিক, দাবদাহে স্বাভাবিকভাবে সেসব ফসলের ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে। অনেকে বলেন, তীব্র তাপেও আমের ফলনে ক্ষতি হয়না। এটা ভুল কথা। আমের মুকুলের পোলেন গ্রেইন ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি তাপ সহ্য করতে পারলেও, স্টিগমা বেশি তাপে কার্যকরী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে করে মুকোলদগম হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে।

শুধু আম না, এই দাবদাহ ধানের ক্ষেতেও প্রচণ্ড প্রভাব ফেলবে বলে শঙ্কা করেন তিনি। বর্তমানে মাঠে থাকা বোরো ধানের মাত্র শীষ বের হয়েছে। এ অবস্থায় যে হারে দাবদাহ চলছে তাতে করে গাছের গোড়া শুকিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রা থাকলে চিটা ধানের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যায়। এতে করে ফলনে সরাসরি প্রভাব পড়ে বলে জানান এ উদ্ভিদবিজ্ঞানী।

আম-লিচুর সুতিকাগার বা মূল উৎপাদনের অঞ্চল হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চলকে গণ্য করা হয়। এবারের দাবদাহে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূমির অবস্থা নাজেহাল। বিশেষ করে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত সেচ দিতে পারছেন না কৃষকরা। অন্যদিকে তীব্র গরমে লাগাতার লোডশেডিংয়েও ব্যহত হচ্ছে সেচ কাজ।

দাবদাহে সেচ প্রসঙ্গে কৃষি অর্থনীতি বিশ্লেষক রিপন কুমার মণ্ডল সময় সংবাদকে বলেন, একমাত্র যারা বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ করেন তারাই রিং পদ্ধতিতে প্রতিনিয়ত সেচের ব্যবস্থা করতে পারেন। তবে দেশে আমের বড় একটি মাধ্যম বাণিজ্য বহির্ভূত। এখানে সেচ নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় আর্দ্রতার অভাবে আম ঝরে পড়ছে।

লিচু প্রসঙ্গে রিপন বলেন, এখন লিচুর ফুল মাত্র পাকতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় আর্দ্রতা নিশ্চিত করা না যাওয়ার কারণে হয় ফুলের শিষে পচন ধরছে আর না হলে ঝড়ে পড়ছে। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁর মতো বরেন্দ্র এলাকায় পানির অভাব থাকায় সেখানে লিচুর ফলন এবার কম হবে বলে শঙ্কা আছে।

এবার গ্রীষ্মে ফলন কতটা কমবে জানতে চাইলে রিপন বলেন, এবার বিরূপ তাপমাত্রার কারণে ফলন ২০ শতাংশ কম হবে। আম-লিচুর ফলন এই দাবদাহের কারণে অনেকটাই কমে আসবে। গত কয়েক বছরে যে পরিমাণে আম-লিচুর ফলন হয়েছিল তাতে করে দেশের রফতানির নতুন একটি দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল, যা এবার শঙ্কার মুখে পড়বে।

ফল থেকে খামারি ও জাতীয় পর্যায়ে আয়ে ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি দাবদাহের কারণে ফলের স্বাদেও তারতম্য আসবে জানিয়ে রিপন বলেন, আম-লিচুর মতো ফলে স্বাদ কেমন হবে, তার সঙ্গে আর্দ্রতার সরাসরি সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে এবার লিচু যেভাবে আর্দ্রতা সংকটে আছে, তাতে করে ফলের গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

শুধু দাবদাহ না, সার্বিক আবহাওয়ার প্রভাব এবারের গ্রীষ্মকালীন ফলে পড়বে বলে শঙ্কা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হর্টিকালচার বিভাগের পরিচালক আব্দুল আউয়াল সময় সংবাদকে বলেন,
আমের ফলনে দাবদাহে যতটা না প্রভাব পড়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে প্রলম্বিত শীতের কারণে। এবার শীত শেষে হঠাৎ করে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে আমের মুকুলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে করে গত বছরের তুলনায় এবার ৪০ শতাংশ আমের ফলন কম হয়েছে।

বিশেষ করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেসব আমের গাছ আছে তাতে এ বছর ফলন নেই বললেই চলে। যে সময়ে কীটনাশক দেয়ার কথা তখন কীটনাশক প্রয়োগ করে লাভ হয়নি। জলবায়ুর এই হুট-হাট পরিবর্তনের কারণে গাছে পোকা আসার সময় পর্যন্ত বদলে গেছে বলে জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।

আউয়াল বলেন, এবার বাজারে আমের ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি এই ফল পাকতেও অন্যান্য বছরের তুলনায় কমপক্ষে ১৫ দিন দেরি হবে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাজারে সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ আম চলে আসার কথা। তার কয়দিন পরেই আসার কথা গোপালভোগ। এসব আম বাজারে আসতে আসতে মে মাসের মাঝামাঝি সময় চলে আসবে।

দেশে জনপ্রিয় আমের প্রজাতি আম্রপালিও এবার দেরিতে বাজারে আসবে বলে জানান আউয়াল। তিনি বলেন, যেখানে আগে জুন মাসে বাজারে আম্রপালি চলে আসে, এ বছর সেই আম আসতে আসতে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগবে।

একে ব্যক্তিপর্যায়ে এবার আম-লিচুর ফলন নেই বললেই চলে, অন্যদিকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে আম-লিচুর ফলন কম। এতে করে গ্রীষ্মকালীন ফল নিয়ে সিন্ডিকেটের শঙ্কা করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আউয়াল বলেন, লিচু বাজারে ১৫ দিনের বেশি থাকে না। বাজারে পাকা লিচু আসতে শুরু করলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়। এতে করে সিন্ডিকেট করে লাভ হবে না। তবে ফলন কম হওয়ায় গত বছরের তুলনায় এ বছর আম-লিচুর দাম বেশি থাকবে বলে জানান তিনি।