নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ!

5
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ!

৭ জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নতুন সংসদ সদস্যগণ শপথ নিয়েছেন। নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি শুরু হয়েছে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন। বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের অন্যতম লক্ষ্য ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দুর্নীতিমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া।

গত বছর আগস্টে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানায় দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ৪৭ ভাগ বেকার। ২০১৯ সালে বিআইডিএসের এক গবেষণায় দেখা যায়—শিক্ষিত যুবকের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩.৩২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসেবে দেশে এখন বেকার ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এই বেকারের মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার মানুষ পুরুষ আর ৯ লাখ ২০ হাজার নারী। বেকার আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপরও নির্ভর করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যারা উচ্চ শিক্ষা নেন তারা বেকার থাকেন বেশি। অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা বেকার সংখ্যা কম। এখানেই কোয়ালিটি এডুকেশনের প্রশ্ন আসে।

Pop Ads

পাবলিক পরীক্ষার আলোকে চালু হয়েছিল পিইসি ও জেএসসি। এর ফলে কোমল শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষায় এচঅ-এ ভালো করার জন্য শুরু হয়েছিল মানসিক নির্যাতন। কেড়ে নেওয়া হয় তাদের মধুর শৈশব। সঙ্গে অভিভাবকদের পকেটও কম খালি হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়েও চলে আসে নোট-গাইড। প্রতিযোগিতা শুরু হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের তোতা পাখি বানানোর প্রতিযোগিতা।

চালু হয়েছিল সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি। আর সৃজনশীল পদ্ধতিতে নোট-গাইড বই থেকে বেরিয়ে আসার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের। কোচিং-প্রাইভেট লাগবে না বলা হয়েছিল। কিন্তু দুর্বোধ্যতার কারণে শুধু ছাত্রছাত্রী নয়—এনটিআরসির রিপোর্ট অনুযায়ী ৫০ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নই করতে পারেন না। আর যারা পারেন—তারাও কষ্ট স্বীকার করতে চান না। দ্বারস্থ হলেন নোট-গাইড বইয়ের। তাই শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, স্কুল-কলেজের লাইব্রেরি, শিক্ষকদের বাসা-বাড়িও দখল করল নোট-গাইড বই।

যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, সংস্কার বা পরিমার্জনের প্রয়োজনে—২০২৩ সাল থেকে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শুরু হওয়া প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এ কারিকুলাম ২০২৭ সালে শেষ হবে দ্বাদশ শ্রেণিতে বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে এ কারিকুলাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগণ ১১তম গ্রেডে, সহকারী শিক্ষকগণ ১৩তম গ্রেডে চাকরি করেন। ১৩তম গ্রেড—অন্য সরকারি অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরও নিচে। নেই তাদের সময়মতো প্রমোশন। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় তিন জন শিক্ষক নিয়ে ক্লাস চলছে বছরের পর বছর। প্রায় ৫০ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো কর্মচারী নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারেনি। প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে উন্নীত করা প্রয়োজন।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক জনশিক্ষককে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াতে হয়। নিতে হয় একটানা পাঁচ থেকে ছয়টা ক্লাস। এর ওপর বিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন করা, খাতা দেখা সব মিলে তারা থাকেন ক্লান্ত। দেশে এখন অনেক শিক্ষিত বেকার। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ এখন সময়ের দাবি।

দেশের যেসব বেসরকারি কলেজে অনার্স আছে—অনার্সের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়াও দেশে এখনো অনেক নন এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। তাদের অবস্থা খুবই করুণ। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকগণ একটিমাত্র পদোন্নতি—প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন। সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি প্রয়োজন। ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অথচ এই শিক্ষকগণের অবসর সুবিধার টাকা পেতে লেগে যায় তিন-চার বছর। অনেকে জিবদ্দশায় এ টাকা হাতে পান না। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?

শিক্ষকদের মর্যাদা ও পৃথক বেতনকাঠামো দিয়ে আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। এজন্য আরো শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমাতে হবে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে জিডিপির ছয় শতাংশ করতে হবে।

একই পদে একই ব্যক্তি দীর্ঘ সময় থাকলে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই কলেজের গভর্নিং বডি বা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে একই ব্যক্তিকে দুই বারের বেশি নিয়োগ বন্ধ করা প্রয়োজন। ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডিতে বিদ্যোত্সাহী সদস্য দলীয় বিবেচনায় না করে—শিক্ষায় অবদান আছে এরকম বরেণ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। বরেণ্য ব্যক্তিদের প্যানেল তৈরির জন্য প্রতিটি উপজেলায়—উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে নিয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শিক্ষার সব ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এখানে কোনো আপস করা চলবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। দলীয় বিবেচনায় নয়—প্রথিতযশা ব্যক্তিদের দিয়ে পাঠ্যবই লেখা ও সম্পাদনার কাজ করতে হবে। তা না হলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শঙ্কামুক্ত হবে না।

প্রয়োজনীয় এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করে নতুন সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের অন্যতম লক্ষ্য ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কর্মসংস্থান ও স্মার্ট বাংলাদেশ ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতিগঠন। এজন্য শিক্ষার্থীদের মেধাসম্পন্ন শিক্ষকের হাতে তুলে দেওয়ার আশু ব্যবস্থা গ্রহণ কাল নয় আজই প্রয়োজন—এটাই জাতির প্রত্যাশা।