বছরজুড়ে রাজপথে থাকা বিএনপি গ্রেপ্তার-সাজায় কোণঠাসা

6
বছরজুড়ে রাজপথে থাকা বিএনপি গ্রেপ্তার-সাজায় কোণঠাসা

দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। প্রবল প্রতিকূলতার মাঝে বিদায়ী বছরটি কার্যত ছিল বিএনপির আন্দোলনের বছর। সরকার পতনের দাবিতে বছরের শুরু থেকেই রাজপথে সক্রিয় ছিল বিএনপি। বছরের দ্বিতীয় ভাগে রাজপথের আন্দোলন তুঙ্গে থাকলেও বছর শেষে চাপে পড়েছে দলটি। ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ পণ্ডের পর দলটি হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচিতে গেলে বেশ চাপে পড়ে। হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও সাজার কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দলটির নেতা-কর্মীরা। বেশিরভাগ নেতা-কর্মী দুই মাস ধরে বাসাবাড়িতে থাকতে পারছেন না।

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আন্দোলন আরো জোরদার করার লক্ষ্যে নানা কৌশল অবলম্বন করছে বিএনপি। বছরের প্রথম ভাগে বড় আন্দোলনের পটভূমি রচনার জন্য প্রথমে দলের নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করতে সারা দেশেই জনসংযোগ, বিক্ষোভ, সমাবেশ-তারুণ্যের সমাবেশ, মহাসমাবেশ, গণঅবস্থানসহ বিভন্ন কর্মসূচি পালন করে। তবে বিএনপির মূল দাবি সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মেনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করলে বিএনপি সরকারবিরোধী দল ও জোটগুলোকে নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের পথে নামে। এজন্য দাবি আদায়ে পদযাত্রা, গণঅবস্থান, গণমিছিল ও রোডমার্চ কর্মসূচি দিয়ে রাজপথ ব্যাপক সরগরম করে বিএনপি ও তার মিত্ররা।

Pop Ads

শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে এসব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন হলেও গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় দলটির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে কঠোর হয়ে ওঠে সরকার। গ্রেপ্তার করা হয় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বিএনপির বেশ কজন সিনিয়র নেতাকে। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান মাঠে সক্রিয় থাকা দলটির বহু নেতা-কর্মী। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপিসহ অন্তত ৬২টি দল।

গত ১২ জুলাই নয়াপল্টনে সারা দেশ থেকে আসা নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মহাসমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য দেওয়া ছিল দলের নেতা-কর্মীদের কাছে বড় চমক। সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ দলের কর্মসূচিকে বেগবান করেছে। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের পরদিন থেকে দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে দলটি ও তার মিত্ররা। এরই মধ্যে ঘনিয়ে আসে নির্বাচনের সময়।

দিন যত যায়, বিএনপির এক দফার দাবি আরো জোরালো হয়। বিপরীতে চলে দল ভাঙার বহু চেষ্টা-ফিকির। নির্বাচন ঘিরে বিএনপির কতিপয় নেতা ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বিএনপির এই ‘অখণ্ডতাকেই’ বছরের একটি বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন।

আগামী ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, নির্বাচনের নামে বানর খেলায় যাবেন না। নির্বাচনে কারা এমপি হবেন সেই তালিকা তৈরি হয়ে গেছে। রিজভী বলেন, সরকারকে সকল প্রকার কর, খাজনা, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুিবল দেওয়া স্থগিত রাখার অনুরোধ করছি। ভোটগ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।

সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার পাশাপাশি বছরজুড়েই দলের চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা এবং বিদেশে উন্নত চিকিত্সার ইস্যুটিও ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। পুরো বছর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে সাজা দেওয়া হয় এ বছরই।

বছরের শেষ দিকে এসে গত পনেরো বছরে নাশকতার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় দেড় হাজারের মতো বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আসে কারাদণ্ডের রায়। দণ্ডিতের তালিকায় দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও রয়েছেন। আদালত থেকে রিমান্ড ও সাজার ঘটনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

গত ২৮ অক্টোবরের ঢাকায় মহাসমাবেশের পর ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে দলটির ২৪ হাজার ৬৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। যার মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ শীর্ষ অনেক নেতা রয়েছেন। গ্রেপ্তারের পর এসব নেতা-কর্মীর আদালতে হাজির করাকে ঘিরে পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় ছিল রাজনীতির উত্তাপ।

বিদায়ী ২০২৩ সালে সারা দেশে বিএনপির ৯৪ জন নেতা-কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন। গত ২৮ ও ২৯ জুলাই ২০২৩ থেকে অদ্যাবধি বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে মোট ২৭ হাজার জন নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার-কারারুদ্ধ হয়েছেন। মামলা হয়েছে ১১ হাজারের অধিক, যাতে আসামি ৯৮ হাজার ৯৫৩ জন। মূলত একটি আন্দোলনমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপির বছর শুরু হয়েছিল। একটি অসহযোগ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ২০২৩ সালের বিদায় ঘটে। এখন বিএনপির টার্গেট ভোট বর্জন এবং সরকারের পতন।