বয়ঃসন্ধিকাল: কিশোর-কিশোরীদের মনের যত্ন

বয়ঃসন্ধিকাল: কিশোর-কিশোরীদের মনের যত্ন

শৈশব পার হয়ে কৈশোর, এরপর যুবক। এরই মাঝখানে থাকে কিশোরবেলা, বয়ঃসন্ধিকাল। ১০ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বয়সটি হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল। এ সময়েই একজন কিশোর বা কিশোরীর জীবনে মানসিক, শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তন ঘটে। একদিকে তারা বড় হতে থাকে, আবার শৈশবকেও পুরোপুরি ছেড়ে আসতে পারে না। এ সময় কিছুটা মানসিক টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে।

কিশোররা এ সময় নিজেকে স্বাধীন ভাবে, বাবা-মায়ের খবরদারি পছন্দ করে না। নিজে নিজে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে চায় এবং কখনও বাবা-মায়ের সঙ্গে রূঢ় আচরণও করে। বাবা-মায়েরা এ বয়সের কিশোরকে কখনও বলেন ‘বড়’; আবার কখনও বলেন ‘ছোট’। দশম শ্রেণীতে পড়া ছেলেটি বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি চাইলে বাবা-মা বলেন, ‘তুমি এখনও অনেক ছোট, বড় হলে তারপর যাবে।’ আবার এই ছেলেটিকেই পরদিন বাবা বাজার করতে দিলে ছেলেটি বলে, ‘আমি পারব না।’ তখন বাবা উত্তর দেন, ‘তুমি এত বড় হয়েছ, আর এই সামান্য কাজটি করতে পারবে না?’ সে পড়ে যায় পরিচয়ের সংকটে, সে কি ‘বড়’ না ‘ছোট’? কিশোরীদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রায় একই রকম।

Pop Ads

পারিবারিক অনুশাসনগুলো অনেক বেশি করে তার ওপর আরোপ হতে থাকে। হরমোনের পরিবর্তনসহ মানসিক বিকাশের পর্যায় অতিক্রম করতে করতে আবেগের ঝড় বয়ে যায় তাদের মনে। নিজের শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশও বদলাতে থাকে। ছোটদের সঙ্গেও তারা মিশতে পারে না, আবার বড়দের আসরেও তারা সাদরে গৃহীত হয় না। নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে তারা এ বয়সে জানতে শুরু করে এবং শৈশবের ধারণার সঙ্গে তা না মিললে মনের মধ্যে জন্ম নেয় দ্বন্দ্ব।

নিজেদের শারীরিক পরিবর্তনও কিশোর-কিশোরীকে কিছুটা অন্তর্মুখী করে তোলে। কখনও তৈরি হয় বয়ঃসন্ধিকালের সংকট বা অ্যাডোলেসেন্ট ক্রাইসিস। এদের নিয়েই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। …শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্র“টিও যেন অসহ্য বোধ হয়।’

আসলেই কি তাই? এই কিশোরবেলা কি কেবলই ‘বালাই’? আসলে এ সময়টা একজন মানুষের বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর সংবেদনশীল। এ সময়টিতে একজন কিশোর বা কিশোরী শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি তার জ্ঞান, মনোসামাজিক আর নৈতিকতা বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলো অতিক্রম করে। এ সময় মনের যতœ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। সুইস মনোবিজ্ঞানী জ্যঁ পিয়াজে শিশু-কিশোরদের জ্ঞানের বিকাশের (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) বিখ্যাত তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ৭ থেকে ১১ বছর বয়সের একটি শিশুর মধ্যে কংক্রিট অপারেশনাল পর্যায় দেখা যায়।

যখন আশপাশ সম্পর্কে সে অনেক যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে। কোনো বস্তুর ধারণায় সে গুণগত মানকে প্রাধান্য দেয়। আর ১১ বছরের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত তার মধ্যে ফরমাল অপারেশনাল পর্যায় দেখা যায়। যখন তার ধারণার জগৎটি অনেক বিস্তৃত ও বিমূর্ত হতে থাকে এবং কার্যকারণ বিবেচনা করে সে তার ধারণা প্রস্তুত করে। এই ফরমাল অপারেশনাল পর্যায়ে একজন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে যে কোনো বিশ্বাস বা আদর্শ দানা বাঁধতে থাকে। এই বিশ্বাস বা আদর্শ হতে পারে পুরোপুরি আত্মকেন্দ্রিক ক্যারিয়ারনির্ভর অথবা পার্থিব ভোগবাদে পরিপূর্ণ, কখনও বা কিছুটা আত্মবিধ্বংসী।

আর যদি এ সময়টায় সে সঠিক মনের যতœ পায়, ইতিবাচকভাবে আশপাশটাকে উপলব্ধি করতে পারে তবে সে-ই হয়ে উঠতে পারে পরার্থবাদী আদর্শ একজন মানুষ। তাই এই ১১-১২ বছরের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের বিকাশটি ইতিবাচক হওয়া খুব জরুরি। মনে রাখতে হবে, এ সময় তার মধ্যে যেন কোনো ‘কগনিটিভ এরর’ বা ভুল ধারণার স্তর তৈরি না হয়।

মার্কিন গবেষক লরেন্স কোহলবার্গ, পিয়াজের ধারণার জগৎ বা জ্ঞানের বিকাশের পর্যায়গুলোর সঙ্গে নৈতিক বিকাশের যোগসূত্রও তুলে ধরেন। মানুষের নৈতিকতা বিকাশের পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোহলবার্গ তিনটি স্তরের বর্ণনা দিয়েছেন। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর শাস্তি এড়াতে শিশুরা নিয়মকানুন মেনে চলে, এরপর কিশোরবেলায় সে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়- ‘ভালো ছেলে’ বা ‘ভালো মেয়ে’ অভিধায় তারা ভূষিত হতে চায়। আর নৈতিকতার বিকাশের তৃতীয় স্তর- যা শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়সের দিকে।

তখন সে নৈতিকতাকে নিজস্ব ধারণার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতে থাকে। তার ধারণার জগৎ বা জ্ঞানের বিকাশ যদি হয় প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতিপন্থী, তবে তার নৈতিকতার চর্চা হয় সমাজ অনুগামী। আর তার ধারণার জগতে যদি সে বিশ্বাস করে এই সমাজ, এই প্রচলিত রীতিনীতি ‘সঠিক নয়’, তখন সে তার চারপাশকে পরিবর্তন করতে চায়। পরিবর্তনের পন্থা হতে পারে প্রচলিত পদ্ধতিতে অথবা তার নিজস্ব বিশ্বাসের মতো করে। এই পরিবর্তনের যে কোনো পথকে সে নিজস্ব যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে। কিশোরবেলা থেকে পরিণত বয়স, যেমন ২৫-২৬ বছর পর্যন্ত একজন তরুণের মনোজগতের এই পরিবর্তনটি আশপাশের সবাইকে বুঝতে হবে। এ বয়সে তার মনোজগতের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী- খেয়াল রাখতে হবে, এই পরিবর্তন যেন ইতিবাচক দিকে পরিচালিত হয়।

বাবা-মায়েরা বেশিরভাগ সময় সন্তানের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন। দৈনন্দিন পরিচ্ছন্নতা, অসুখ-বিসুখ নিয়ে তারা ভাবেন। সময়মতো ব্যবস্থা নেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তারা সন্তানের মনের সমস্যাগুলো সহজে চিহ্নিত করতে পারেন না। অনেক সময় সামাজিক সংস্কারের কারণে মানতে চান না যে তাদের সন্তানের মনের রোগ হয়েছে। বিষয়টি লুকিয়ে রেখে সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তোলেন তারা। শরীরে কোনো রোগ না থাকলেও শারীরিক সুস্থতার জন্য যেমন প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করতে হয়, গোসল করতে হয়, সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হয়; তেমনি মনের সুস্থতার জন্য নিয়মিত মনের যতœ নিতে হয়, মনকে তার ‘খাদ্য’ দিতে হয়, মনের ‘ব্যায়াম’ করতে হয় আর মনের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে দূরে থাকতে হয়।

নিজেদের মনের যতেœর জন্য কিশোর-কিশোরীরা নিয়ম করে ঘুমানো, নিয়মিত পারিবারিক আড্ডা, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে সক্রিয় অংশগ্রহণ, নিয়ম মেনে হালকা ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, দ্বন্দ্ব-কলহ ও মাদকের নেশা এড়িয়ে চলা, অনৈতিকতার চর্চা পরিহার- এ বিষয়গুলো মেনে চলতে পারে। নয়তো মন ভালো থাকবে না, আর মন ভালো না থাকলে সার্বিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব হবে নয়, কিশোর-কিশোরীদের মনোসামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

সন্তানের মনের যতেœর জন্য বাবা-মায়েদেরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বাড়িতে নৈতিকতা আর সততার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তানকে উচ্চৈঃস্বরে বা উত্তেজিত হয়ে কোনো আদেশ বা ধমক দেয়া নয়, শান্তভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে। ছোট-বড় অর্জনে তার প্রশংসা করতে হবে, মাঝে মাঝে তা উদ্যাপন করতে হবে। জিপিএ-৫ পেতেই হবে, অমুক জায়গায় ভর্তি হতেই হবে- এ ধরনের চাপ শিশু-কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর। ‘উপেক্ষা’ একজন কিশোর-কিশোরীর আবেগের ওপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলে।

তাই কোনোক্রমেই তাকে উপেক্ষা করা যাবে না। কোনো পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তার মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। তাকে ব্যঙ্গ করা বা আরেকজন কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে তার তুলনা করা চলবে না। মনে রাখতে হবে, এই কিশোরবেলা মোটেই সংকটকাল নয়, বরং সম্ভাবনার সময়। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তাকে আগামী দিনের উপযোগী একজন মানবিকবোধসম্পন্ন মেধাবী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তার মনের যতœ নিতে হবে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সহস্র কিশোর-কিশোরীর মনোসামাজিক উৎকর্ষ বৃদ্ধির যে চেষ্টা পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) করছে এ জন্য উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানাই।

আহমেদ হেলাল : শিশু কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ