মানুষ চাঁদে গিয়েছে জানেন কি?

13
মানুষ চাঁদে গিয়েছে জানেন কি?

মানুষ কি চাঁদে গিয়েছিল? ছবি, ভিডিওসহ অসংখ্য অকাট্য প্রমাণ আছে। তবুও একদল মানুষ মাঝে মাঝে প্রশ্ন তোলে, কনস্পাইরেসি থিওরি কপচায়। কিছু ব্যাপ্যারে তাদের খটকা আছে, কিছু প্রশ্ন আছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কমন শত্রু ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানী পরাস্ত-বিপর্যস্ত। তাদের পক্ষে আর তখন সম্ভব নয় বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব তখন দিনকে দিন বাড়ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নও কম যায় না।

Pop Ads

শুরু হয় দুই মহাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধ। বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে তখন পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে তারা। সব কিছুতেই প্রতিদ্বন্দ্বীতার ছোঁয়া। যুদ্ধের সময় রকেট সায়েন্সে যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে।

সেটাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে চায় দুই দেশ। শুরু হয়, রকেটের মাধ্যমে মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতা।
সেই প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেকটাই এগিয়ে যায়, ১৯৫৭ সালে। স্পুৎনিক ১ নামের প্রথম মহাকাশযান তারা মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে। প্রতিযোগিতা এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু।

এরপর দুই দেশ মরীয়া মহোশূন্যে মনুষ্যবাহী মহাকাশযান উৎক্ষেপণের জন্য। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল রুশ নভোচারী ইউরি গ্যাগারিনে প্রথম মানুষ হিসেবে মহাশূন্যে পাড়ি দেন। তৈরি হয় ইতিহাস। পরাজিত মার্কিন গবেষকেরা। তাঁদের আঁতে ঘা লাগে। প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে এভাবে হার! এর বদলা তারা নিতে চায় অন্যভাবে। হ্যাঁ, চাঁদে মহাকাশযান পাঠানোর প্রতিযোগিতা শুরু করে।
রুশরা যখন চাঁদে মনুষ্যবিহীন নভোযান পাঠানোর তোড়জোড় করছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ১৯৬৫ সালে ঘোষণা দিয়ে বসেন, ষাটের দশক শেষ হওয়ার আগেই চাঁদে নভোচারীদের পায়ের ছাপ দেখতে চান। এই ঘোষণায় ভড়কে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকেরা অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে তাচ্ছিল্য করেছিল। কিন্তু চার বছরের মাথায় যখন নীল আর্মস্ট্রং আর অলড্রিন চাঁদের বুবে পা রাখলেন, সেই খবর হজম করতে রাশিয়ার সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়েছিল । তারা বিশ্বাস করেনি, কোনো মরুভূমিতে বানানো দুদার্ন্ত এক সাইফাই বলে প্রচার করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। কারণ, তখনকার যে মহাকাশপ্রযুক্তি সেটা দিয়ে চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের নভোচারীরা, সেটা বিশ্বাস করাও তাঁদের জন্য কঠিন ছিল।

তাই চাঁদের অভিযানের ভিডিও ও ছবি দেখে নানা প্রশ্ন তুলতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু গুজব রটনাকারীরা। শুধু কি সোভিয়েত থেকে, গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব একের পর এক ধেয়ে আসে প্রশ্নবাণ। এমনকী খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই রব ওঠে।

নাসা এ নিয়ে মাঝে মাঝে জরিপ চালায় নিজেদের দেশে। ফলাফল মোটামুটি একই থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ মানুষ মনে করে চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোটাই ধাপ্পাবাজি। পাঁচ শতাংশ সংখ্যাটা কম মনে হতে পারে। কিন্তু যেকোনো গুজব বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জিইয়ে রাখতে ৩০ কোটি জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ বা ছয় কোটি লোক একেবারে কম নয়। সারাবিশ্বে চাঁদ অভিযানকে ঘিরে ছড়ানো গুজব রটনাকারীর সংখ্যাটা অনেক বড়।

এই দলেরই একজন ছিলেন মার্কিন সাংবাদিক বিল কেসিং। ১৯৭৬ সালে তিনি একটা বই লেখেন। নাম ‘উই নেভার ওয়েন্ট টু মুন: আমেরিকা’স থার্টি বিলিয়ন ডলার সুইন্ডল’। এই বইয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন, মানুষ আসলে কখনো চাঁদে যায়নি। সেটা ছিল নাসার তিন হাজার কোটি ডলারের প্রতারণা। তিনি এই বইয়ে খুঁটিনাটি সন্দেহগুলো তুলে ধরেন, তখন থেকেই চাঁদ অভিযানের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু বিল ক্যাসিংয়ের কথাই বা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করবে কেন? করেছিল, কারণ ক্যাসিং এক সময় নাসার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন।

শেষ কথা
এত কিছুর পরও সোভিতে ইউনিয়ন কিন্তু চুপ হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করেত পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এমন অবুঝের মতো কথা বলবেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নের গবেষকেরা এ বিষয়ে জলঘোলা করেননি। তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন পরাজয়। যদি সত্যি মানুষ চাঁদে না যেত, তৈরি করা কোনো ভিডিও হতো, সেটা কি সোভিয়েত গবেষকেরা টের পেতেন না। মিথ্যে হলে নিশ্চয়ই তাঁরা চুপ করে থাকতেন না!

সাড়ে পাঁচ দশক পেরিয়ে গেছে। এখন প্রযুক্তি বদলে গেছে। মানুষ চাইলেই ইউটিউব বা অন্যকোনো প্ল্যাটফর্ম থেকে দেখে নিতে পারে চাঁদে কীভাবে অভিযান চালানো হয়। অনেকে দেখে মাথা নাড়েন, ‘এতদিন আসলে ভুল বুঝেছি’ বলে। কিন্তু প্রযুক্তির অন্যদিকও আছে, সোস্যাল মিডিয়া যেমন ভালো কাজে ব্যবহার করা যায়, গুজব ছড়ানোর জন্য এরচেয়ে সুবিধাজনক মাধ্যম আর হতে পারে না।

তাই গুজব ব্যবসায়ীরা ইউটিউব, ফেসবুকের মতো স্যোসাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের ভিউ বাড়িয়ে নিচ্ছে নিজেদের মতো করে ভুলভাল ব্যাখ্যা দিয়ে। গত পঞ্চাশ বছর নাসা ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বহুবার চাঁদে অভিযানের পেছনে যে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আছে সেগুলোর প্রতিটার চুলচেরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যা শুনে অনেক যেমন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে, তেমনি গুজব রটনাকারীদের ভুল যুক্তি শুনে নতুন নতুন সন্দেহবাদীর জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ যারা মনে করেন, মানুষ আদৌ কখনো চাঁদে যায়নি, এদেরকে জিজ্ঞেস করুন, মানুষ কবার চাঁদে গিয়েছিল?

তারা অবাক হবে, ফ্যাল ফ্যাল করে আপনার দিকে তাকাবে। তারমানে তারা জানেই না আর্মস্ট্রং, অলড্রিনের পর আরও দশজন নভোচারী পাঁচ দফায় চাঁদের বুকে পা রেখেছিল। অর্থাৎ বাঁকি পাঁচটি অভিযানের কথা জানেই না এরা। তথ্য যত কম, সন্দেহ তত বেশি, এ তো জানা কথা। তাই অনুরোধ করব, যারা এই লেখা পড়ছেন, অথচ চাঁদে অভিযান নিয়ে যাদের সংশয় আছে, তারা দয়া করে বিশ্বস্ত সোর্স থেকে চাঁদ অভিযানের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা জেনে নিন।

অনেকে আবার জানেন মানুষ একাধিকবার চাঁদে গিয়েছিল, তারা হয়তো চাঁদ নিয়ে গুজবের ব্যাখ্যাতেও সন্তুষ্ট। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর আর কেন চাঁদে মনুষ্য অভিযান চালানো হলো না, সে নিয়ে দ্বিধায় থাকেন।

আসলে চন্দ্রজয় কেবল শখের বশে করা কোনো অভিযান নয়। মহাকাশে নিজেদের আধিপত্য ছাড়াও মানবজাতির সুদুরপ্রসারী কল্যাণও এর অন্যতম কারণ। চাঁদ সম্পর্কে জানা গেলে, এর ভূপ্রকৃতি, ভূপৃষ্ঠের উপাদান, ইত্যাদি থেকে অনেক তথ্য জানা যায়। আদৌ সেখানে বায়ুমণ্ডল আছে কিনা, মাটির নিচেয় কোনো পানির উৎস আছে কিনা, মাটির উপদানগুলো কী কী, সেখানে ভবিষ্যতে মানব কলোনি তৈরি করা সম্ভব ছিল কিনা, এগুলো জানা গুরত্বপূর্ণ ছিল। এসব যখন জানা হয়ে গেছে, তখন চাঁদ অনেকটাই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া চাঁদে মহাকাশযান পাঠানো যেখানে ব্যয়বহুল, চাঁদে মানুষ পাঠানো আরও ব্যয়বহুল। যখন নাসা বুঝতে পারে, মানুষ স্বশরীরে না গিয়েও হয়তো অনেক তথ্য পেতে পারে, তখন চাঁদে মনুষ্য অভিযান বন্ধ করে দেয়।

তাছাড়া শুধু চাঁদ নিয়ে পড়ে থাকলেই তো চলবে না। গোটা মহাবিশ্ব সম্পর্কেই জানার বাকি। মঙ্গল, শনি, বৃহস্পতি একসময় মানুষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তারপর চোখ যায় সৌরজগতের বাইরে। এ সব গবেষণার পেছনে প্রচুর খরচ আছে। সেসব খরচ জোগান দিতে গেলে চাঁদ অভিযান বন্ধ রাখার বিকল্প ছিল না। গত পাঁচ দশকে ভয়েজার, ক্যাসিনি, হাবল, পার্কার, জেমস ওয়েবের মতো শত শত অভিযান পরিচালনা করেছে নাসা। চীন, রাশিয়া, জাপান ও ভারতের গবেষকেরা মহাকাশে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তারপরও আবার চাঁদে মানুষ পাঠানো মিশনে নেমেছে নাসা। এরই প্রস্তুতি হিসেবে আর্টেমিস ওয়ান নামে একটি নভোযান পাঠিয়েছে চাঁদে। আর্টোমিসের পরবর্তী মিশনগুলোতে চাঁদে আবার মানুষের পায়ের ছাপ ফেলার প্রস্ততি নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া চীন ও ভারতও মানুষকে চাঁদে পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করেছে। তাই এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যারা মনে করছেন, মানুষের চাঁদে যাওয়ার গল্পটা ধাপ্পাবাজি, তাদের জন্য সমবেদনা ছাড়া আর কিছুই নেই আমার কাছে।