হ্যাকিং নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা

5
হ্যাকিং নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা

তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে মানুষ চাইলেই একে অন্যের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য জেনে নিতে পারে। কারো বিষয়ে ভালো কোন তথ্য জানা যেমন সম্ভব, খারাপ কোন বিষয় প্রচার করাও অসম্ভব কিছু না। তবে এক্ষেত্রে ইসলাম কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা অনুসরণ করার মাধ্যমে মানুষ পারস্পরিক সম্পর্ক সুন্দর ও সৌহার্দপূর্ণ রাখতে পারবে। সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে যেতে পারবে।
ইসলাম মানুষের জীবন ও সম্পদের যেমন নিরাপত্তা বিধান করেছে, তেমনই মানুষের মর্যাদাগত বিষয়েরও নিরাপত্তা বিধান করেছে। প্রত্যেক মানুষের জান-মাল অন্যের কাছে যেমন আমানত স্বরূপ, তেমনি প্রত্যেকের মান-মর্যাদা, ব্যক্তিগত বিষয়াবলিও অন্যের কাছে আমানত স্বরূপ। মহান আল্লাহ বলেন,

নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭০)

Pop Ads

প্রযুক্তির এই যুগে মানুষের মর্যাদাহানির অন্যতম মাধ্যম হ্যাকিং। হ্যাকিং এর মাধ্যমে হ্যাকার কম্পিউটার বা মোবাইলের সফটওয়্যার হ্যাক করে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য থেকে শুরু করে গোপনীয় অনেক বিষয় ব্যক্তির বিনা অনুমতিতে হাতিয়ে নেয়। যার ফলে ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে বলেন,

প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান অন্য মুসলিমের জন্য হারাম। (সহিহ মুসলিম ৬৭০৬)

মানুষের সম্পদ চুরি করা যেমন হারাম তেমনই তার কোন গোপন তথ্য চুরি করে তার গোপনীয়তা নষ্ট করা ও তাকে কষ্ট, পেরেশানিতে নিপতিত করাও ইসলামে সুস্পষ্টভাবে হারাম। অনুমতি ছাড়া কারো গোপনীয় কোনকিছুর এক্সেস নেয়া জায়েজ নাই।

অনুমতি ছাড়া গৃহে প্রবেশের বিষয়েও ইসলাম খুব কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কেননা এতে ব্যক্তির গোপনীয়তা ও স্বাধীনতা নষ্ট হয়। মহান আল্লাহ বলেন,

হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত তোমরা অনুমতি পাও এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম না কর। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখ। (সুরা নুর ২৭)

অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয় কাজে আড়িপাতার বিষয়ে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠিন হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘যদি কেউ তোমার ঘরে অনুমতি ছাড়া উঁকি দেয়, তুমি পাথর মেরে তার চক্ষু ফুঁটো করে দাও, এতে তোমার কোনো গুনাহ নেই।’ (বুখারি শরিফ ৬৮৮৮)

বিশেষজ্ঞদের মতে হ্যাকারদের তিনটি শ্রেণি রয়েছে। হোয়াইট হ্যাট, গ্রে হ্যাট ও ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার। এদের মধ্যে ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার বেশ ভয়ংকর। যারা মানুষের তথ্য হ্যাক করে তাদের বিপদে ফেলে দেয়।

ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকারদেরকে সাইবার ক্রিমিনাল নামে আখ্যায়িত করা হয়। তারা অন্যের তথ্য চুরি করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং বিভিন্ন তথ্য চুরি করে অন্যান্য ক্রিমিনাল গ্রুপের কাছে সেই তথ্যগুলো বিক্রিও করে দেয়। এক কথায় ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার বলতে বোঝায় যারা হ্যাকিং করে শুধুমাত্র নিজের আর্থিক লাভ ও অন্যের ক্ষতি করার জন্য।

এ ধরনের হ্যাকিং ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা অপরের গোপন বিষয় অনুসন্ধান কোরো না। (সুরা হুজরাত ১২)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

তোমরা মানুষের দোষ অনুসন্ধান করো না; কারো পশ্চাতে গোয়েন্দাগিরি করো না; হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা চর্চা করো না। সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকো। (সহিহ বুখারি ৫৮২৯)

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার আগে, যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ তার কাছ থেকে নেওয়া হবে আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে নিয়ে তা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারি ২৪৪৯)

গ্রে হ্যাট হ্যাকার অনুমতি ছাড়া কোন সিস্টেম হ্যাক করে থাকলেও সেটির মাধ্যমে কোন তথ্য চুরি করে না। বরং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম হ্যাক করার পরে এর সিকিউরিটি ঠিক করতে সময় দেয়। যদিও তাত্ত্বিক দিক দিয়ে হোয়াইট ও গ্রে হ্যাট হ্যাকারদের মধ্যে খুব বেশি অমিল নেই কিন্তু গ্রে হ্যাট হ্যাকাররা অনুমতি না নিয়েই সিস্টেম হ্যাক করে; ফলে এটি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ইসলামের দৃষ্টিতে এই ক্যাটাগরির হ্যাকিংও জায়েজ নেই। বিনা অনুমতিতে অন্যের গোপন তথ্য খোঁজাও ইসলামে নিষিদ্ধ।

হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন,

তোমার জন্য পর্দা (বাধা) তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই তুমি আমার কাছে এসে আমার গোপন কথা শুনতে পারো, যতক্ষণ না আমি তোমাকে নিষেধ করি। (সুনানে ইবনে মাজাহ ১৩৯)

হোয়াইট হ্যাট হ্যাকাররা মূলত সিকিউরিটি এক্সপার্ট; যাদেরকে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের সিস্টেমের দুর্বলতা খুঁজে বের করার জন্য নিয়োগ দেয়। এদের মধ্যে যারা বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন সিকিউরিটি সিস্টেমের, কম্পিউটার নেটওয়ার্কের ত্রুটি বের করে দেয়, তাদের এমন কাজ ইসলাম অনুমোদন করে না।

তবে কেউ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাদের কোম্পানি বা ব্যক্তির তথ্যের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ত্রুটি বের করার জন্য হ্যাকিং করে, তবে তা জায়েজ হবে। যারা এই প্রক্রিয়ায় বৈধ পদ্ধতিতে মানুষের নিরাপত্তার জন্য কাজ করে, তাদের ইথিক্যাল হ্যাকারও বলে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন। (সুনানে আবি দাউদ ৪৮৯৩)

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রহ.) বলেন, ‘ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তালাশ-অনুসন্ধান নিষেধ। তবে যদি কাউকে রক্ষা করার জন্য অপরিহার্য হয়, তাহলে বৈধ হবে। যেমন, বিশ্বস্ত ব্যক্তি মারফত জানা গেলো যে অমুক কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার জন্য অথবা কোনো মহিলার সাথে যিনা করার জন্য প্রস্তুত। এক্ষেত্রে কিছু ঘটিয়ে ফেলার আগেই যেন তাকে নিবৃত্ত করা যায় সে উদ্দেশ্যে তার ব্যাপারে তদন্ত ও অনুসন্ধান করা যাবে।’(উমদাতুল ক্বারি ১৫/২১৮)

কিছু হ্যাকার আছে যারা তথ্য চুরি না করলেও ডস অ্যাটাকের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইটকে সাময়িক ডাউন করে দেয়। যার দরুন ওই প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে হ্যাক করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। কিছু নিচু পর্যায়ের হ্যাকার এমনও আছে, যারা হ্যাকিংকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় দাঙ্গা পর্যন্ত সৃষ্টি করে। এসব অপকর্ম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

যে অন্যের ক্ষতি করল আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন এবং যে তার সঙ্গে শত্রুতা করবে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন। (সুনানে দারাকুতনি, হাদিস ৩০৭৯)

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। আর যাকে মানুষ তাদের জান ও মালের জন্য নিরাপদ মনে করে সে-ই প্রকৃত মুমিন।’ (তিরমিজি ২৬২৭)

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সুক্ষ্ম অপরাধগুলো থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্মানবোধ নিয়ে জীবনযাপন করার তাউফিক দান করুন।