আরও ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে চাল সংগ্রহের মেয়াদ !

বেসরকারি উদ্যোগেও চাল আমদানির পরিকল্পনা সরকারের :

সুপ্রভাত বগুড়া (জাতীয়): মজুদ বাড়াতে সরকার দেশের ভেতর থেকে চাল সংগ্রহ এবং বিদেশ থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দুই লক্ষ্য এখনও পূরণ হয়নি। এ জন্য গত সোমবার চাল সংগ্রহের মেয়াদ আরও ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে। চাল আমদানিরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিকে চুক্তি মোতাবেক যেসব ব্যবসায়ী সরকারকে চাল সরবরাহ করেননি, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। এর মধ্যে গতকাল ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় গরিবদের মধ্যে চাল বিতরণ কার্যক্রম।

এ খাতে প্রতি মাসে দেড় লাখ টন করে চাল বিতরণ করতে হবে। টানা তিন মাসে (সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর) চাল লাগবে সাড়ে চার লাখ টন। অথচ সরকারের গুদামে বর্তমানে (৩১ আগস্ট পর্যন্ত) চাল মজুদ আছে মাত্র ১১ লাখ টন। গত বছরের এ দিন পর্যন্ত চাল মজুদের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ২৪ হাজার টন। এ অবস্থায় চাল সংগ্রহের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ১৫ দিন। চাল মজুদের মতো ধান সংগ্রহেও একই অবস্থা। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১ আগস্টের মধ্যে আট লাখ টন ধান সংগ্রহের। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র দুই লাখ আট হাজার ৩৩৭ টন বা ২৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয়, যা শেষ হয় গত ৩১ আগস্ট।

Pop Ads

গত চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার বেশিরভাগই অর্জন না হওয়ায় বোরো সংগ্রহের সময়সীমা গত সোমবার আরও ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে। তবে বাড়তি সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। সরকারের অনেক উদ্যোগের পরও ধান-চাল পর্যাপ্ত পরিমাণ সংগ্রহ না হওয়ায় দুশ্চিন্তা কাটছে না। এ প্রেক্ষাপটে যেসব চালকল মালিক সংগ্রহের সময় শেষ হওয়ার পরও চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে চাল সরবরাহ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। ইতোমধ্যে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে এ-সংক্রান্ত চিঠিও পাঠিয়েছে সংস্থাটি।

বেশ কয়েকজন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি-ফুড) সমকালকে বলেন, যেসব চালকল মালিক চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে চাল সরবরাহ করেননি, সংগ্রহ নীতিমালা ও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কারণ, চালকল মালিকরা চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে চাল দিতে বাধ্য। এরপরও যারা চাল দেবেন না, তাদের জামানত ও লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সমকালকে বলেন, চালকল মালিকদের মধ্যে যারা চুক্তি অনুযায়ী চাল দেননি তারা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা পাবেন না। তাদের কালো তালিকায় রাখা হবে।

চুক্তির আগে তারা দুই শতাংশ জামানত দিয়েছেন, সেটাও ফেরত পাবেন না। তাদের লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তারা সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবেন না। খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ব্যবসায় লাভ-লোকসান দুটোই আছে। এর আগে তারা অনেক লাভ করেছেন। করোনার এ সময়ে তারা একটু কম লাভ করলে ক্ষতি হবে না। চাল সংগ্রহের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, চালকল মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংগ্রহের সময় আরও ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে। সংগ্রহের সময় শেষ হলেই চাল আমদানি করা হবে।

খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. বদরুল হাসান সমকালকে বলেন, সীমিত আকারে হলেও সরকারের উচিত চাল আমদানি করা। কারণ, দীর্ঘ চার মাসেও লক্ষ্যমাত্রার বেশিরভাগই পূরণ হয়নি। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনাও কম। তিনি বলেন, করোনা এবং বন্যার কারণে খাদ্যশস্য নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। আর খাদ্য সংকটের একটা বড় কারণ হলো আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা। এ ছাড়া আমন কেমন উৎপাদন হবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। এ জন্য তিন মাস আগেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমদানি করতেও সময় লাগবে। তিনি বলেন, চালের দাম নির্ধারণ করাও সরকারের ঠিক হয়নি। কারণ ২৬ টাকা কেজিতে ধান কিনলে চালের দাম হয় ৪১ টাকা কেজি।

এদিকে যেসব মিল মালিক চুক্তি মোতাবেক পুরো চাল সরকারকে দেবেন, প্রতি কেজিতে তাদের চার টাকা করে প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি। কিন্তু এভাবে প্রণোদনা বা দাম বাড়াতে নারাজ সরকার। কারণ এখন সরকারিভাবে কেজিতে এক টাকা বাড়ালে বাজারে চালের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে খাদ্য কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি দরের চেয়ে খোলাবাজারে ধানের দাম এখন বেশি। তাই কৃষকের কাছেও ধান পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে মিল মালিকদের লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চাল সংগ্রহের সময় আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কারণ, গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের সামান্য বেশি চাল সংগ্রহ হয়েছে। এখনও ৪৫ ভাগ সংগ্রহ করতে হবে।

সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ টন। এর মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র পাঁচ লাখ ৬৩ হাজার ৫৫৫ টন বা ৫৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর আতপ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দেড় লাখ টন। সংগ্রহ হয়েছে ৮২ হাজার ৭৯৫ টন বা ৫৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক একেএম লায়েক আলী সমকালকে বলেন, আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। খাদ্যমন্ত্রী মৌখিকভাবে অনেক কিছু বলেছেন; কিন্তু লিখিতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস এবং বৃষ্টি-বন্যার কারণে মিলগুলো অনেক দিন বন্ধ ছিল। তাই চাল উৎপাদন কাজে অনেক বিঘ্ন ঘটেছে। আবহাওয়া ভালো হলে লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করা হবে।

এখন সরকার চুক্তি অনুযায়ী আমাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতেই পারে। তবে এ ব্যর্থতা থেকে উত্তরণে আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই। ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক তপন কুমার দাস সমকালকে বলেন, কৃষক এবার খোলাবাজারেই ভালো দাম পাচ্ছেন। ফলে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করছেন না। ধানের দাম বেশি হওয়ায় বাজারে চালের দামও বেশি। ফলে মিল মালিকরা সরকারকে চুক্তির দাম অনুযায়ী চাল দেননি। তবে চাল সংগ্রহের জন্য মিল মালিকদের চাপ দেওয়া হচ্ছে। করোনাভাইরাস ও বন্যার কারণে প্রথমদিকে দেশে ধান-চাল সংগ্রহে কিছুটা হলেও প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করছিল।

তবে সে অবস্থা এখন আর নেই। ওই বিরূপ পরিবেশের মধ্যেও সিদ্ধ ও আতপ চাল সরবরাহে যেসব চালকল মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছেন এবং চুক্তি অনুযায়ী পুরো চাল সরবরাহ করেছেন বা করবেন, তাদের ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করবে সরকার। আর যারা চুক্তি সম্পাদন করেও চাল সরবরাহ করেননি, তাদের প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। বেসরকারি উদ্যোগে আমদানির পরিকল্পনা :করোনা ও বন্যার কারণে বাজারে চালের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য শুল্ক্ক কমিয়ে বেসরকারি উদ্যোগেও চাল আমদানি করা হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে কী পরিমাণ চাল আমদানি করতে হবে, সেটা আগেই নির্ধারণ করার জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি পাঠিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম। ডিসিদের কাছ থেকে চাহিদা পাওয়ার পর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে, যাতে কোনোভাবেই ২০১৭ সালের মতো চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি না হয়। এ জন্য চাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে। তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সমকালকে জানিয়েছেন, সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল আমদানি করতে প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিয়েছেন। তবে কোন দেশ থেকে চাল আমদানি করা হবে, সে ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আমদানির বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আমদানির জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি রয়েছে। কেনাকাটার সময়সীমা শেষ হলেই আমদানি করা হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার টু সরকার বা আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে আমদানি করা হতে পারে। বাজারে চালের সংকট দেখা দিলে শুল্ক্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবেও চাল আমদানি করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here