ইসরায়েলে হামাসের হঠাৎ আক্রমণের কারণ কী

142
ইসরায়েলে হামাসের হঠাৎ আক্রমণের কারণ কী

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। অনেকটা আকস্মিকভাবেই ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে এই সংগঠন। এতদিন সাধারণত ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা হামলা চালিয়ে আসছিল হামাস। এবার হামাস কেন আগে হামলা চালাল, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।

সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, হামাসের হামলার প্রাথমিক কারণ ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে আলোচনাকে ব্যাহত করা। কারণ রিয়াদ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছিল।

Pop Ads

এনবিসি নিউজের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ন্যাটোর সাবেক কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল জেমস স্ট্যাভরিডিস বলেন, এই হামলার মাধ্যমে ‘তাদের অদম্য শত্রু ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে’ চাচ্ছে।

রোববার ৮ অক্টোবর বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্যালেস্টাইনের গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র সংগঠন হামাস এবং ইসরায়েলের লড়াইয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। গাজা থেকে চালানো রকেট হামলায় কমপক্ষে ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন।

অপরদিকে, ইসরায়েলি বাহিনীর পাল্টা বিমান হামলায় কমপক্ষে ২৫০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। দু’পক্ষের কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশজুড়ে ৪৮ ঘণ্টার জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইসরায়েল সরকার।

রকেট হামলার জবাবে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল হামাসের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স-আইডিএফ দাবি করেছে, তারা এখন পর্যন্ত ১৭টি সেনা কম্পাউন্ড আর হামাসের অপারেশনের চারটি হেডকোয়ার্টারে হামলা করেছে।

শনিবার ভোরে হামাসের শীর্ষ নেতা মোহাম্মেদ দেইফ এক ভিডিও বার্তায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ এর ঘোষণা দেন। এর পরই ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে শুরু হয় রকেট হামলা। হামাস দাবি করেছে, মাত্র ২০ মিনিটে ইসরায়েলে প্রায় পাঁচ হাজার রকেট ছুঁড়েছে তারা।

হামলা শুরুর পর ইসরায়েলের জনগণের উদ্দেশে এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু জানান, তারা যুদ্ধের মধ্যে আছেন এবং এই যুদ্ধে ইসরায়েল জয়ী হবে।

অন্যদিকে প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, দখলদারদের বিরুদ্ধে নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার গাজাবাসীর রয়েছে।

মাস দাবি করছে, এই হামলার মাধ্যমে জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জোট সরকার এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী হামলার ক্রমবর্ধমান অভিযোগের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ক্র্যাকডাউন পরিচালনা করছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার তথ্যমতে, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের ইতি টানতেই হামাস এ সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ‘অপারেশন আল-আকসা স্টর্ম’ পরিচালনার মাধ্যমে দশকের পর দশক ধরে চলা ইসলায়েলি দখলদারিত্ব, শোষণ ও বঞ্চনার জবাব দেওয়া হচ্ছে বলে আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন হামাস মুখপাত্র খালেদ কারামি।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং পুরো বিশ্বের মানুষ আমাদের ওপর পরিচালিত অত্যাচারের কথা জানুক। আমরা চাই আমাদের মানুষ এবং আমাদের ভূখণ্ডের ওপর, আমাদের পবিত্র প্রার্থনা কেন্দ্র আল-আকসার দখলদারিত্ব থেকে ইসরায়েলিরা সরে যাক। অনেক বছরের পুঞ্জিভূত অত্যাচার ও দখলদারিত্বের জবাব দিতেই আমরা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছি।

ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং শোষণের অবসানে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মেদ দেইফ বলেন, আমরা অপারেশন আল-আকসা স্টর্ম শুরু করে দিয়েছি। এ অভিযানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান হবে।

দেশপ্রেমিক সব প্যালেস্টাইনকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের কূটনীতিকরা এনবিসি নিউজকে বলেন, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি চুক্তির প্রতি সমর্থন করছেন। যার ফলে কূটনৈতিকভাবে সৌদি আরব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।

কূটনীতিকরা বলছেন, সৌদি আরব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হলে তা অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোকেও প্রভাবিত করবে।

যদিও তিনটি পক্ষেরই এই ধরনের চুক্তির জন্য জটিল শর্ত রয়েছে। অতীতের সৌদি শাসকদের পথ থেকে সরে এসে বিন সালমান ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এটি সৌদি আরবকে বিশাল অর্থনৈতিক সুবিধা দেবে।

গত মাসে এনবিসি নিউজ ‘লেস্টার হল্ট’র সাথে একটি সাক্ষাৎকারে ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি বলেন, আমরা আমাদের আঞ্চলিক দেশ এবং ইহুদিবাদী শাসকদের মধ্যে যেকোন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, ইহুদিবাদী শাসক আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে চাইছে এই অঞ্চলে নিজের জন্য নিরাপত্তা তৈরি করতে।’

সৌদি, ইসরায়েলি এবং আমেরিকানদের সাথে আলোচনা যত এগিয়েছে প্যালেস্টাইনদের হতাশা ততই বেড়েছে উল্লেখ করে ন্যাটোর সাবেক কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল জেমস স্ট্যাভরিডিস বলেন, সৌদি এবং ইসরায়েলিদের কাছাকাছি যেতে দেখে প্যালেস্টাইনদের মধ্যে একটি স্পষ্ট হতাশা রয়েছে।

নেতানিয়াহু ইসরায়েলিদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজনও সৃষ্টি করেছেন। তিনি এমন একটি বিচারিক সংস্কারের দিকে যাচ্ছেন, যা ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টকে দুর্বল করে দেবে। এমন একটি সংস্কার, যা সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

ইসরায়েলি পার্লামেন্ট দ্য নেসেট একটি আইন প্রণয়নের পর মার্চে সংস্কারের প্রথম অংশ পাস হয়। যা একজন প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ থেকে রক্ষা করে। এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীকে শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বা মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে ক্ষমতাচ্যুত করা যেতে পারে এবং শুধুমাত্র নেতা এবং তাদের অফিস এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

সমালোচকরা আদালতের সংস্কারের নিন্দা জানিয়েছিলেন। তারা বলেন, এটি ইসরায়েলের মধ্যে ক্ষমতার গণতান্ত্রিকতা দুর্বল করে দেবে। কেউ কেউ এমনও উল্লেখ করেন, নেতানিয়াহুকে দুর্নীতির অভিযোগের সম্মুখীন হওয়ার পরে নেতৃত্বে রাখার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল।

জুলাই মাসে পাস হওয়া সংস্কারের দ্বিতীয় অংশ দেখা যায়, আদালত সরকারী সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক ঘোষণা করতে বাধা দেবে। সেই মাসে ইসরায়েলের চ্যানেল-১৩ এর একটি জরিপে দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ ইসরায়েলি আশঙ্কা করেছিলেন ‘বিচারিক সংস্কার গৃহযুদ্ধের জন্ম দেবে’।

স্টারভিডিস বলেন, হামাস এবং তার পৃষ্ঠপোষকরা ইসরায়েলের গভীর রাজনৈতিক বিভাজনকে হামলার সম্ভাব্য সুযোগ হিসেবে দেখেছিল। তিনি বলেন, ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের মধ্যে একটি ধারণা রয়েছে যে এটি ‘কখনও বেশি বিভক্ত হয়নি, কখনও দুর্বল ছিল না, কখনও আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়নি।’

ইসরায়েলি লেখক এবং ইয়েদিওত আহরনোট সিনিয়র কলামিস্ট নাদাভ ইয়াল একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, এই হামলা দেশটিকে আরও রূপান্তরিত করবে। এই ঘটনাটি একটি জাতীয় ট্রমা ছিল। ‘এটি ৯/১১ এর মতো কিংবা এর চেয়েও বড়।’

তিনি বলেন, আমাদের বেশ কয়েকজন বেসামরিক লোক এখনও অপহৃত আছে। দেশের বিভাজন যাই হোক না কেন, ইসরায়েল সামরিকভাবে জবাব দেবে।

অবশ্য ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে প্রায় ২৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এছাড়া গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি স্থল হামলার আশঙ্কা রয়েছে।