ইসলামে গৃহকর্মীদের অধিকার

5
ইসলামে গৃহকর্মীদের অধিকার

জীবনের প্রয়োজনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার উদ্ভব হয়। দরিদ্র মানুষ আর্থিক প্রয়োজনে ধনীদের দ্বারস্থ হয়; কিন্তু ধনীদের জীবন গরিব মানুষের সহযোগিতা ছাড়া চলে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি তোমার রবের করুণা বণ্টন করে? আমিই তাদের মধ্যে জীবিকা বণ্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে। আর তারা যা জমা করে তা থেকে তোমার রবের অনুগ্রহ উত্কৃষ্টতর।

’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৩২)
দরিদ্র জনগোষ্ঠী পেটের জ্বালায় ধনীদের কায়কারবার আঞ্জাম দেয় কায়িক শ্রমের মাধ্যমে। কাজের ধরন অনুসারে এদের একেকজন একেক অভিধায় পরিচিত। গৃহকর্মী যারা, তারা কাজের বেটা-কাজের বেটি, চাকর-চাকরানি, আয়া, বুয়া, ঝি ইত্যাদি যে নামেই পরিচিত হোক না কেন, তাদের অবস্থা বড়ই করুণ।

Pop Ads

জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় ২৩, ২৪ ও ২৫ অনুচ্ছেদে শ্রমিকের মানবাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সব কর্মী বা শ্রমিকের সমমজুরি, বিশ্রাম, অবসর, যুক্তিযুক্ত কর্মঘণ্টাসহ শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার্থে সব অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।

যুক্তিযুক্ত মজুরির বিনিময়ে কাজের নিশ্চয়তা এবং যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন, অবকাশ ও প্রয়োজনীয় সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে বিধৃত হয়েছে। এ ছাড়া সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী প্রত্যেক মানুষের এই সর্বজনীন অধিকারটি আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
আইনে বলা আছে : গৃহকর্মে কিশোর বা কিশোরী (১৪ থেকে ১৮ বছর) নিয়োগ করতে হলে অভিভাবকের সঙ্গে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে নিয়োগে ইচ্ছুক ব্যক্তির সঙ্গে নিয়োগকর্তার চুক্তি থাকতে হবে এবং উক্ত চুক্তিতে উভয় পক্ষের নাম, ঠিকানা, স্বাক্ষরসহ নিম্নোক্ত শর্তসমূহের উল্লেখ থাকতে হবে :

১.১) নিয়োগের ধরন, ১.২) মজুরি, ১.৩) কর্মঘণ্টা, ১.৪) বিশ্রামের সময় ও ছুটি, ১.৫) লেখাপড়ার ব্যবস্থা, ১.৬) কাজের ধরন, ১.৭) থাকা-খাওয়া ইত্যাদি। তা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় না।

শান্তির ধর্ম ইসলামে গৃহকর্মীদের অধিকার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেমন—
সুন্দর নামের অধিকার : প্রতিটি মানবসন্তানের জন্মের পর তার মা-বাবা আদর করে নাম রাখেন। তাই তার অধিকারের অন্যতম একটি হলো তাকে তার নামেই ডাকা হবে। কিন্তু গৃহকর্মীদের যেন সে অধিকারটুকু নেই। তাদের নাম বাদ দিয়ে কাইল্যা, ধইল্যা, বুয়া, বেটি ইত্যাদি ও নামের বিকৃত উচ্চারণে ডাকা হয়, যা তাদের অধিকারের পরিপন্থী এবং তাদের প্রতি চরম উপহাসের শামিল।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনরা! কোনো পুরুষ যেন অন্য কোনো পুরুষকে উপহাস না করে। কেননা হতে পারে উপহাসকারী অপেক্ষা সে উত্তম। আর কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে। কেননা হতে পারে উপহাসকারিণী অপেক্ষা সে উত্তম। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ কোরো না এবং মন্দ নামে ডেকো না। কেউ ঈমান আনার পর কাউকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহর কাজ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা করে না, তারাই জালিম।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১১)
জীবনের নিরাপত্তা : অনেক সময় দেখা যায়, গৃহকর্মীরা কর্মস্থলে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়, কখনো তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। অথচ তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যায় হত্যাকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোনো নরহত্যা কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণে বিচারের রায় ছাড়া যদি কেউ কোনো মানুষকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন সব মানুষকে (মানবতাকে) হত্যা করেছে।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩২)

একটি হত্যা সমাজে বহুমুখী ক্ষত সৃষ্টি করে। এটি সমাজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, সমাজের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে। হত্যা মানবসভ্যতার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করে। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে মানবপ্রাণকে আল্লাহ অত্যন্ত মর্যাদাশীল করেছেন, তোমরা তাকে ন্যায়ানুগ কারণ ছাড়া হত্যা কোরো না।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৫১)

উপযুক্ত পারিশ্রমিকের অধিকার : নিয়োগকর্তার দায়িত্ব হলো অধীনদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো মজুর নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২২৭)

খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের অধিকার : ইসলাম দাস-দাসীদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছে। মহান আল্লাহ পাক দাস-দাসীদের সব দিকে পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) দাস-দাসীদের বিষয়ে বিদায় হজের ভাষণে অত্যন্ত কঠোরভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা দাস-দাসীদের ওপর অত্যাচার কোরো না। তোমরা যা খাবে দাস-দাসীদের তা খেতে দেবে, নিজেরা যা পরবে তাদের তা পরতে দেবে। (সিলসিলা সহিহাহ, হাদিস : ৭৪০)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই ছোট অমিয় বাণীই বিশ্বের সব যুগের সব মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। এ সম্পর্কে আবু জার (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জেনে রেখো, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাআলা তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন নিজে যা খায় তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরিধান করে, তাকেও তা-ই পরায়। তাদের ওপর এমন কাজ চাপিয়ে দিয়ো না, যা তাদের জন্য বেশি কষ্টদায়ক। যদি এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহলে তোমরাও তাদের সে কাজে সহযোগিতা করবে। (বুখারি, হাদিস : ৩০)

অন্য হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত, একবার তার কর্ম তত্ত্বাবধায়ক তাঁর কাছে এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি গোলামদের তাদের খোরাকি সরবরাহ করেছ? সে বলল, না। তখন তিনি বলেন, তুমি এখনই যাও এবং তাদের খোরাকি দিয়ে দাও। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তির গুনাহের জন্য এটাই যথেষ্ট যে সে ওই ব্যক্তির খোরাকি আটক করে রাখে, যার খোরাকি তার জিম্মায় আছে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, কোনো ব্যক্তির গুনাহের জন্য এটাই যথেষ্ট যে যার খাদ্য এই ব্যক্তির জিম্মায় আছে, সে তা নষ্ট করে দেয়। (মুসলিম, হাদিস : ২২০২)

যারা খাবার তৈরি করে, খাবার গ্রহণের সময় তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন তোমাদের কারো খাদেম খানা তৈরি করে, অতঃপর সে উক্ত খানা তার মালিকের সম্মুখে উপস্থিত করে, অথচ সে আগুনের তাপ ও ধোঁয়ার কষ্ট সহ্য করেছে, তবে যেন মালিক তাকে নিজের সঙ্গে বসায় এবং নিজের সঙ্গেই খানা খাওয়ায়। কিন্তু খাদ্যের পরিমাণ যদি কম হয়, তাহলে অন্তত তা হতে এক-দুই গ্রাস খানা তার হাতে তুলে দেয়। (বুখারি ও মুসলিম)