এবার সিন্ডিকেটের নজর বগুড়ার ডালের বাজারে

এবার সিন্ডিকেটের নজর বগুড়ার ডালের বাজারে

মোঃ এমদাদুল হক: বগুড়ায় হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে ডালের বাজার এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা মসুর ডাল পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি বেড়েছে নয় টাকা এবং খুচরা বাজারে বেরেছে ১৫ টাকা। বাজারে যেকোনো প্রকারের সবজি এখন সর্বনিম্ন প্রতি কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে, মাছ মাংস নিন্ম আয়ের মানুষের কাছে কিনতে পারা অনেকটাই অসাধ্য সাধন করার মত।

সাধ্যমত মাছ-মাংস কিনতে না পেরে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী লোকজন প্রায়শই একটি কথা বলেন-দুটো ডাল ভাত খেয়ে বাঁচতে চাই, কিন্তু সেটাও যেন দিন দিন কঠিন হয়ে উঠেছে নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য। বগুড়ার পাইকারি বাজারে হঠাৎ বেড়েছে ডালের দাম, কেজি প্রতি মোটা মসুর ডাল এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৮৭ টাকার পরিবর্তে ৯ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯৬ টাকায়, এবং খুচরা বাজারে ৯৫ টাকার পরিবর্তে ১১০ টাকায়, এছাড়াও বিভিন্ন রকমের ডাল প্রকারভেদে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে তিন থেকে আট টাকা পর্যন্ত।

Pop Ads

বাংলাদেশ সরকার এক কোটি মানুষকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর কার্ডের আওতায় এনে মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, চিনি, চাল, ইত্যাদি ভর্তুকি মূল্যে খুব অল্প দামে বিক্রি করে আসছে, এতে নিন্ম আয়ের মানুষজন অনেকটাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, কিন্তু যারা এই কার্ড পাননি এরকম লক্ষ লক্ষ নিম্ন আয়ের মানুষ বেঁচে থাকার সংগ্রামে হাঁপিয়ে উঠেছেন। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।

বগুড়ার ফতেহ আলী বাজার এলাকায় কথা হয় মাদলা থেকে আগত ষাঠউর্দ্ধো আব্দুল হামিদের সাথে, উদাশ নয়নে তাকিয়ে তিনি জানান আমি বরাবরই ফতেহ আলী ব্রিজের ফুটপাত থেকে মোটা ডাল কিনি এ ডালের দাম একটু কম পাওয়া যায়, একমাস পূর্বেও এখান থেকে মসুর ডাল কিনেছি ৮০ টাকায়, কিন্তু আজ দোকানদার দাম চাচ্ছে ১১০ টাকা কেজি, আমরা বাপু দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ সামান্য মোটা ডালের দাম-ও যদি এভাবে বাড়ে তাহলে ডাল ভাত খাওয়াও মুশকিল হয়ে যাবে।

ফতেহ আলী ব্রিজের গোড়ায় ফুটপাতে ডাল বিক্রি করছিলেন হেলাল নামক একজন ব্যবসায়ী তার সাথে কথা হলে তিনি জানান “আমি দীর্ঘদিন যাবত এখানে ফুটপাতে বিভিন্ন ধরনের ডাল বিক্রি করি,সাধারণত নিন্ম আয়ের মানুষজন আমার কাছ থেকে কম দামে ডাল কিনে তাই আমি সাধারণত মোটা ও কম দামের ডাল বিক্রি করি”।

ডালের দাম বাড়ার বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান-আমি ৮-৯ দিন আগেও মোটা মসুর ডাল ৫০ কেজির বস্তা ৪২০০ টাকায় কিনেছিলাম কিন্তু এখন এই ডালটি কিনতে গিয়ে আমাকে মোকামে দাম দিতে হয়েছে ৪৮০০ টাকা, হিসাব করে দেখেন আমাকে কেজিতে ১২ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে, এরকম খেসারি, মুগ, বুটের ডাল সহ প্রায় প্রতিটি ডালেই ৬ টাকা ৮ টাকা এমনকি ১০ টাকা কেজিপ্রতি বাড়তি দিয়ে কিনতে হয়েছে তাই আমি বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করছি, দাম বাড়ার কারণে আগের তুলনায় বেচাকেনা অনেক কমে গেছে।

সরেজমিনে বগুড়ার একমাত্র ডালের পাইকারি বাজার নামাজগড় ডালপট্টির আরত গুলোতে ঘুরে দেখা গিয়েছে তিন, চার ও পাঁচ সেপ্টেম্বর বাজারে পাইকারী নিপার মোটা মসুর ডাল ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি ৪৮০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে যা গত ৭ থেকে ১০ দিন আগেও ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি ৪২০০ থেকে ৪৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

এবং প্রকারভেদে বিভিন্ন ধরনের মসুর ডাল ৪৪০০ থেকে ৪৬০০ টাকা দর ছিল, এই দরের ডাল গুলোতেও বস্তা প্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বেড়েছে। খেশারি ডাল ২৫ কেজির বস্তাপ্রতি ২০০০ থেকে ২১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যা গত একসপ্তাহ আগেও ২৫ কেজির বস্তাপ্রতি ১৮০০ টাকা থেকে ১৯০০ টাকা বিক্রি হয়েছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে খেসারি ডালে বেড়েছে কেজি প্রতি ৮ টাকা।

ছোট মুগ ডাল ২৫ কেজির বস্তাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩০৫০ থেকে ৩১০০ টাকায় যা একসপ্তাহ আগেও ২৫ কেজির বস্তাপ্রতি ২৯০০ থেকে ২৯৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে মুগ ডালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা, বুটের ডাল ২৫ কেজির বস্তা ১৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যা এক সপ্তাহ আগেও মূল্য ছিল ১৭৫০ টাকা। তবে স্থানীয় ডাল পট্টির বিভিন্ন আরত ভেদে নানান রকমের ডালের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত দামে কমবেশি রয়েছে।

কথা হয় নামাজগড়ের বড় ডাল ব্যবসায়ী নামে পরিচিত শম্ভু অ্যান্ড ব্রাদার্সের ক্যাশিয়ার নিতেন এর সাথে নিতেন এই প্রতিবেদককে বলেন “বিগত এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি ডাল তিন থেকে নয় টাকা ক্ষেত্রবিশেষে ১০ টাকা বেড়েছে। আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অটো মিল রয়েছে কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত আমাদের মিল বন্ধ রয়েছে, আমরা বিভিন্ন ইম্পোর্টার ও মিলারদের কাছ থেকে ডাল কিনে বিক্রি করে থাকি, আমার জানামতে বছরের এরকম সময়ে ডালের দাম বাড়ে না” কিন্তু হঠাৎ কেন ডালের দাম এভাবে বাড়লো এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন “সম্ভাব্য এতে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে বিশেষ মহল কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে ডালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে আমি মনে করি” নিতেন আরও বলেন এখনই যদি সরকারের কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বাজার মনিটরিং না করেন তাহলে আগামীতে ডালের বাজার আরো অস্থির হয়ে ওঠার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

বগুড়ার নামাজগড় অস্থ ডালপট্টিতে কথা হয় দিশা ট্রেডার্স এর মালিক ও ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহিদ মুস্তাফা (লিটন) এর সাথে হঠাৎ ডালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে দৈনিক সময়ের কাগজকে তিনি জানান “এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের ব্যবধানে বাজারে চাষী পর্যায়ে কালাই এর দাম বেড়েছে তাই প্রকার ভেদে বিভিন্ন ধরনের ডাল এর দাম বেড়ে গেছে, এছাড়াও বগুড়ার ডালপট্টির বেশিরভাগ ব্যবসায়ী, মিল মালিকদের কাছ থেকে ডাল ক্রয় করে বিক্রয় করে, মিলে ডালের দাম বাড়তি তাই বাধ্য হয়ে আমাদেরকেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

সিন্ডিকেট এবং কৃত্রিম সংকটের বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন সিন্ডিকেট বিষয়টি আমার জানা নেই তবে আমি এটুকু বলতে পারি যে বাজারে কালাই এর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এই বৃদ্ধির কারণেই ডালের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি ডালের দাম আরো বৃদ্ধি পাবে এরকম আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন বাজারে কালাই এর দাম প্রতিনিয়ত যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী সপ্তাহ থেকে প্রতি কেজি ডালে আরো তিন থেকে চার টাকা এবং প্রকারভেদে আরো বেশি হারে দাম বাড়ার প্রবল সম্ভবনা রয়েছে। কালাইয়ের বাজার কোথা থেকে নিয়ন্ত্রণ হয়, এরকম প্রশ্ন করায় ডাল ব্যবসায়ী সমিতির এই সভাপতি বলেন দেখুন কালাই বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয় এটার মূল বাজার চট্টগ্রাম, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কালাইয়ের বাজার পাবনা কুষ্টিয়া যশোর থেকে খুলনা অঞ্চল সেখানে কালাইয়ের বাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করে বগুড়া থেকে বসে এটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

সচেতন মহল মনে করছেন বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং নিন্ম আয়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকার টিসিবির মাধ্যমে মানুষের মাঝে অল্প মূল্যে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য বিক্রয় করে আসছে, এতে কোটি মানুষ উপকৃত হলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো এই সুবিধার বাইরে রয়ে গিয়েছে, যদি বাজার মনিটরিং না থাকে এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে আগামীতে সরকারের গ্রহণ কৃত এই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকার পরেও মুষ্টিমেয় কিছু দুর্বৃত্তের জন্য বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন আরো দুর্ভিসহ হয়ে উঠবে।