ওষুধের অপব্যবহার: ইচ্ছেমতো খাওয়া অনুচিত

2
ওষুধের অপব্যবহার: ইচ্ছেমতো খাওয়া অনুচিত

অসুখ হলে ওষুধ খেতে হয়, এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এবং সঠিক নিয়মে ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করি না। ওষুধ খেতে আমরা যতটা তত্পর, ওষুধ খাওয়ার নিয়ম মানতে ততটাই উদাসীন। আমাদের এই অবহেলা জীবন রক্ষাকারী ওষুধকে করে তুলতে পারে জীবনবিনাশী।

ওষুধগ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই যে অনিয়মটা করি, তা হলো চিকিৎসকের পরামর্শ না নেওয়া। আমরা নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা করি, কখনো আত্মীয়, কখনো বন্ধুর পরামর্শ নিই, কখনো চিকিৎসকের চেয়ে ওষুধ বিক্রেতার ওপর বেশি নির্ভর করি। ‘অমুক ওষুধে তমুক ভালো হয়েছিল, তাই আমিও ভালো হব’—এমন চিন্তাই আমাদের মধ্যে কাজ করে। অথচ লক্ষণ এক হলেই অসুখ এক হবে, এমন কোনো কথা নেই। আবার একই রোগে একই ওষুধের মাত্রা রোগীভেদে ভিন্ন হতে পারে। শুধু অসুখে নয়, ওষুধ সহজলভ্য হওয়ায় আমরা অন্যের পরামর্শে সামান্য রোগেও ওষুধ খাই। মোটা হওয়ার জন্য স্টেরয়েড বা শক্তি বাড়ানোর জন্য ভিটামিন খাই খাদ্যের চেয়ে বেশি। এসবের মারাত্মক, কখনো জীবনবিনাশী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

Pop Ads

যদি কখনো-বা বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিই, ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের বেঁধে দেওয়া বিধিনিষেধ অনেক সময় মানি কম। সময়মতো ওষুধ খাওয়া, খাওয়ার আগে, না পরে তা বুঝে খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা, এসব আমরা খেয়াল রাখি না। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রার ক্ষেত্রে আমরা পুরোপুরি উদাসীন থাকি। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো পূর্ণ মাত্রা কমপ্লিট না করে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া। ‘দু-তিন দিন ওষুধ খেয়ে জ্বর ভালো হয়ে গেছে, অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার আর কী দরকার’ ভেবে নিজেরাই ওষুধ বন্ধ করে দিই। আবার অন্যদিকে কয়েক দিনে রোগ ভালো না হলে ‘ওষুধ কার্যকরী নয়’ ভেবে তা বন্ধ করে দিই এবং অন্য চিকিৎসকের কাছে নতুন ওষুধের প্রত্যাশায় যাই। যেসব অসুখে দীর্ঘদিন বা আজীবন ওষুধ খেতে হয়, সেখানে আমরা অসুখ নিয়ন্ত্রণে এলেই তা বন্ধ করে দিই, বুঝতে চাই না যে, রোগ ভালো হয়নি, নিয়ন্ত্রণে আছে কেবল, যেমন উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ।

ওষুধ ব্যবহারে অনিয়মে যেসব ক্ষতি হতে পারে: অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার জীবাণুর বিরুদ্ধে এদের অকার্যকর করে দিচ্ছে। সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যে রোগ শুরুতেই ভালো করা যেত, অপব্যবহারের কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না, নতুন দামি ওষুধ দরকার হচ্ছে, কখনো তাতেও কাজ হচ্ছে না। বিশেষভাবে বলা যায় যক্ষ্মার কথা, যেখানে কমপক্ষে ছয় মাস ওষুধ খেতে হয়, অথচ অনেকেই কয়েক মাস খেয়ে ‘ভালো হয়ে গেছি’ মনে করে তা বন্ধ করে দেয়। তখন তা মারাত্মক ড্রাগরেজিস্ট্যান্স টিবিতে পরিণত হয়, যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। আর্থিক দিকটাও বিবেচনা করা জরুরি। যে চিকিৎসা এখন সুলভে হচ্ছে, অবিবেচকের মতো ওষুধ খেলে তা পরবর্তী সময়ে ব্যয়বহুল হয়ে যেতে পারে।

নিরাময় নয়, নিয়ন্ত্রণ করতে হয় :শুধু জীবাণু সংক্রমণ নয়, কিছু কিছু রোগ নিরাময় নয়, নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, যেমন—উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি অসুখেও ‘মাঝে মাঝে’ ওষুধের ব্যবহার বা ‘ইচ্ছেমতো ওষুধ বন্ধ করা’ উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে। নিয়মিত ওষুধ খেলেও যদি সেবনবিধি না মানা হয়, তাহলে অনেক ওষুধই অকার্যকর হয়ে যায়। খালি পেটে খাওয়ার ওষুধ ভরা পেটে খেলে তা না খাওয়ার মতোই হবে। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই এক ওষুধ অন্য ওষুধের উপস্থিতিতে কাজ করে না।

মনের মতো ওষুধ খাওয়ার আরেক সমস্যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ব্যথার ওষুধ খেয়ে পেপটিক আলসার বেড়ে যাওয়া বা পেট ফুটো হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। মোটা হওয়ার জন্য স্টেরয়েড খেয়ে অনেকেই মারাত্মক কুশিং সিনড্রোমে আক্রান্ত হন, যা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া হঠাত্ ওষুধ বন্ধ করেও অনেকে বিপদে পড়েন, বিশেষ করে স্টেরয়েড হঠাত্ বন্ধ করলে অ্যাডিসনিয়ান ক্রাইসিস হতে পারে, যা থেকে রোগী মারাও যেতে পারে।

আমরা অনেকেই জানি না যে, ভিটামিন ‘এ’ বা কৃমির ওষুধের মতো সাধারণ ওষুধ গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করে। লিভারের রোগীর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ হতে পারে ক্ষতির কারণ। এ অবস্থার জন্য দায়ী আমরা সবাই। রোগী যেমন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাহুল্য ভাবছেন, চিকিৎসক তেমনি রোগীকে অনেক সময় সঠিক পরামর্শ দেন না। চিকিৎসক রোগীকে ওষুধ দেওয়ার সময় সেই ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, তা রোগীকে বলা উচিত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রোগী, চিকিৎসক, ওষুধবিক্রেতা এবং প্রশাসনের যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে।

রোগীদের যা মেনে চলা উচিত: শুধু চিকিৎসক পরামর্শ দিলেই ওষুধ সেবন করা উচিত। বিশেষ অবস্থায় (যেমন গর্ভাবস্থা, লিভারের রোগ ইত্যাদি) সাধারণ ওষুধ যা প্রেসক্রিপশন ছাড়া পাওয়া যায়, তা-ও চিকিৎসকের পরামর্শেই ব্যবহার করতে হবে। শুধু ফার্মাসিস্টের কাছ থেকে ওষুধ কেনা উচিত। কেনার সময় ওষুধের মেয়াদকাল দেখে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ রোগ সারানোর পরিবর্তে ক্ষতি করতে পারে।

চিকিৎসক ওষুধ খাওয়ার যে নিয়ম বলে দেবেন (কতটুকু ওষুধ, কতক্ষণ পরপর, কত দিন, খাওয়ার আগে না পরে ইত্যাদি), তা মেনে সেবন করতে হবে। প্রয়োজনে তা লিখে বা মনে রাখতে অন্যের সাহায্য নিতে হবে। নিজে থেকে ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করা যাবে না। অনেকে একবার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বারবার সেই ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনেন। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে প্রথম ব্যবস্থাপত্রে যে ওষুধ যত দিন খেতে বলা হয়েছে, তত দিনই খাওয়া যাবে। পুনরায় একই অসুখ হলেও সেই একই ওষুধ কাজ না-ও করতে পারে।

সামান্য কারণেই ব্যথার ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই খাওয়া উচিত নয়। নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না। সুস্থ বোধ করলেও কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। কোনো সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একই সঙ্গে অ্যালোপ্যাথিক ও অন্যান্য পদ্ধতির চিকিৎসা চালালে তা চিকিৎসককে জানানো উচিত। ওষুধ সব সময় আলো থেকে দূরে, ঠান্ডা, শুষ্ক স্থানে, শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। কিছু কিছু ওষুধ ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হয়। নির্ধারিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করলে এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়।

অনেক সময় দোকানিরা প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ না দিয়ে শুধু বিক্রি করার জন্য অন্য কোম্পানির অন্য ওষুধ দিয়ে থাকেন, বলেন ‘একই ওষুধ’। এক্ষেত্রে রোগীদের সতর্ক থাকা উচিত এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত নামের ওষুধ কেনা উচিত। বাচ্চা ও বয়স্কদের বেলায় আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। তাদের বেলায় ওষুধের মাত্রা, চোখের ড্রপ বা মলম এবং ইনজেকশনের প্রয়োগবিধির (যেমন মাংসে বা শিরায়) ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

চিকিৎসকের দায়িত্ব: রোগীকে রোগ ও ওষুধ সম্পর্কে মোটামুটি কমবেশি জানানো উচিত। ওষুধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানানো এবং কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে, ওষুধ আপাতত বন্ধ করে দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে। যেসব ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি বা সব সময় খেতে হবে, তা নিজে থেকে বন্ধ করলে কী ক্ষতি হতে পারে তা রোগীকে জানানো উচিত। কখন এবং কীভাবে ওষুধ বন্ধ করা যাবে, তা রোগীকে জানানো উচিত। নিয়মিত ও নিয়মমতো ওষুধ খেতে উত্সাহিত করতে হবে। রোগীর আর্থিক সামর্থ্য ও খরচের দিকটা বিবেচনায় রাখতে হবে। অযথা অতিরিক্ত দামি ওষুধ নেহাত প্রয়োজন বা জীবন রক্ষাকারী না হলে, না লেখাই ভালো। প্রেসক্রিপশনে অসুখের নাম, ওষুধের নাম, মাত্রা, খাওয়ার নিয়ম, কত দিন খেতে হবে ইত্যাদি স্পষ্টাক্ষরে সুন্দরভাবে লেখা উচিত।

ডাক্তারদের মনে রাখা উচিত, অযথা অতিরিক্ত ওষুধ না লেখাই ভালো। তাতে রোগী অনেক সময় ঠিকমতো ওষুধ খেতে পারে না, এমনকি যে ওষুধটা বেশি প্রয়োজন, তা বাদ দিয়ে হয়তো অপ্রয়োজনীয় ওষুধটিই সেবন করতে পারে। যেমন—যক্ষ্মার রোগীর বেলায় অনেকে যক্ষ্মার ওষুধের সঙ্গে স্বাস্থ্য ভালো করার জন্য ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, আয়রন ইত্যাদি লিখে থাকেন। দেখা যায়, রোগী যক্ষ্মার ওষুধ বাদ দিয়ে এগুলোই বেশি খাচ্ছে। ফলে রোগের অবস্থা আরো ভয়াবহ হচ্ছে।

ওষুধ বিক্রেতার কর্তব্য: ওষুধ বিক্রেতাকে অবশ্যই কিছু দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে হবে। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করা উচিত। শুধু ব্যাবসায়িক স্বার্থে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া সব ওষুধ বিক্রি করা উচিত নয়। তবে ‘ওভার দ্য কাউন্টার‘ বিক্রির জন্য, যা আইনগতভাবে বৈধ, শুধু সেগুলোই বিক্রি করা যাবে। সুন্দরভাবে প্যাকেটের ওপর প্রয়োজনীয় মাত্রা, কতবার, কীভাবে সেবন করতে হবে, খাওয়ার আগে বা পরে, তা ভালোভাবে লিখে দেওয়া উচিত। তা না হলে রোগীকে বা রোগীর লোকজনকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব: ওষুধ যেহেতু একটি অতি প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী পণ্য, তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বও অনেক বেশি। দোকানে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা ও সার্বিক তত্ত্বাবধান করা উচিত। শিক্ষিত বা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট ছাড়া অন্য কেউ যেন ওষুধ বিক্রি না করে, তার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।অননুমোদিত ওষুধপত্র বিক্রি বন্ধ করা উচিত। মাঝেমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে পরিদর্শন টিম থাকা ভালো, যাদের কাজ হবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ওষুধের দোকানে নিয়মিত চেকআপ এবং ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করা।সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধের সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করাও জরুরি। দেশে বিভিন্ন ধরনের অপচিকিৎসা, কুচিকিৎসা, তাবিজ-কবজ বা ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক পন্থায় যেসব কুচিকিৎসা চলে, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

মোট কথা, আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকতে এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্ম যেন সুস্থভাবে সুস্বাস্থ্য নিয়ে গড়ে ওঠে, তার জন্য ওষুধের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ওষুধের অপব্যবহার, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স থেকে নিজেদের এবং ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।