কারবালার হৃদয়বিদারক শাহাদতের ইতিহাস

কারবালার হৃদয়বিদারক শাহাদতের ইতিহাস। প্রতিকী-ছবি

আলহজ্ব হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুল হক

সুপ্রভাত বগুড়া (ধর্ম ও জীবন): মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রাঃ) সর্বসম্মতিক্রমে খলীফা নির্বাচিত হন। তিনি অন্তিম মুহুর্তে জনগণের অনুরোধে সাহাবীদের মত যাচাই করে হযরত উমর (রাঃ) কে পরবর্তী খলীফা নির্বাচিত করেন। হযরত উমর (রাঃ) এক ইহুদীর তরবারির দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শাহাদতবরণ করার আগে একটি শুরা কমিটি গঠন করে যান। তারা অনেক মতামতের পর হযরত উসমান (রাঃ) কে খলীফা মনোনীত করেন। হযরত উসমান (রাঃ) বিদ্রোহীদের দ্বারা শাহাদতবরণ করলে জনসাধারণ হযরত আলী (রাঃ) কে খলীফা মনোনীত করেন।

এ সময় হযরত মুআবিয়া (রাঃ) সর্বাগে হযরত উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের বিচারের প্রশ্নে হযরত আলী (রাঃ) এর হাতে বাইআত না হয়ে নিজেই ইসলামী রাজ্যের এক অংশের শাসক হন। হযরত আলী (রা) একদিন ফজর নামাজে এক খারিজীর তরবারীর দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে পরে শাহাদতবরণ করেন। তাঁর শাহাদতের পর হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) জনগণের রায়ে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। কয়েকমাস পর কুচক্রী ইহুদীদের চক্রান্তে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এর সাথে হযরত হাসান (রাঃ) এর ভুল বুঝাবুঝি হয়।

Pop Ads

এক পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের উপক্রম হয়। এমতাবস্থায় হযরত মুআবিয়া (রাঃ) একটি শান্তিচুক্তি পেশ করলে ইমাম হাসান (রাঃ) সেই সন্ধিতে রাজি হন এবং নিজের খিলাফতের দাবি প্রত্যাহার করেন। ফলে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) পুরো মুসলিম জাহানের একক আমীর হন। তাঁর অন্তিম মুহুর্ত ঘনিয়ে আসলে নিজ পুত্র ইয়াযীদকে পরবর্তী খলীফা নির্বাচিত করেন। ৬৮০খ্রিস্টাব্দে ইয়াযীদ ক্ষমতায় বসেই স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সে ইমাম হুসাইন (রাঃ) সহ অন্যান্য মর্যাদাবান ও প্রভাবশালী লোকদের জোরপূর্বক বাইআত করার চেষ্টা করে। ফাসেক ইয়াযীদের তল্পিবাহকরা অনেক চেষ্টা ও প্রলোভন দেখিয়েও আনুগত্য আদায়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।

ইমাম হুসাইন (রাঃ) ইয়াযীদের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের পথে কুফাবাসীর আমন্ত্রণে পরিবার-পরিজনসহ ইরাকের কুফা শহরে রওনা হন। চলতে চলতে ৩ই মুহাররম কারবালার মুরু প্রান্তরে পৌঁছেন। তখন কুফার গভর্ণর উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদের আদেশে উমর বিন সাদের নেতৃত্তে¡ ইয়াযীদি সৈন্যরা কারবালা এলাকা ঘিরে ফেলে এবং ফোরাত নদীর পানি ইমাম হুসাইন ও তাঁর সাথীদের জন্য নিষিদ্ধ করে। মরুভূমির প্রচন্ড গরম এবং উত্তপ্ত বালিতে সকলেরই প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত। পানি পানি করে ছোট ছেলে-মেয়েরা চিৎকার করতে লাগলো। তবুও ইমাম হুসাইন (রাঃ) ইয়াযীদকে খলীফা মানতে প্রস্তুত হলেন না।

দীর্ঘ সাতদিন ইমাম হুসাইন (রাঃ) কে সময় দেয়া হয়েছিল স্বীয় আদর্শকে জলাঞ্জলী দিয়ে ইয়াযীদকে খলীফা হিসাবে মেনে নেওয়ার জন্য। কিন্তু বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন, হক্বের ঝান্ডাবাহক ইমাম হুসাইন (রাঃ) সেই প্রস্তাব ঘৃণভরে প্রত্যাখান করেন। অবশেষে ৯ই মুহাররম রাতে ইমাম হুসাইন (রাঃ) নিজ সাথীদের সাথে পরামর্শ করেন। পরদিন ১০ই মুহাররম ৬১ হিজরীতে ফজর নামাজের পর যুদ্ধ যখন অনিবার্য তখন ইমাম হুসাইন (রা) এক আবেগঘণ ভাষণ দেন। তাঁর সেই ভাষণ পাপিষ্ট অন্তরগুলোয় কোন রেখাপাত করেনি। এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।

হাজার হাজার সৈন্যদের সাথে লড়তে লড়তে এক সময় উপুর হয়ে মাটিতে পড়ে যান ইমাম হুসাইন (রাঃ)। এই সুযোগে কুখ্যাত সীমারের নির্দেশে সিনান বিন আনাস হযরত ইমাম হুসাইনের মাথা মুবারক শরীর থেকে আলাদা করে। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) হত্যা ও মাথা বিচ্ছিন্ন করার পরও উন্মত্ত সীমার ঘোড়ার খুরের আঘাতে তাঁর মৃতদেহ ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে।

জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়-
“কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
সে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে”
কিন্তু সে কাঁদন পাষানহৃদয় সীমারদের কাঁদাতে পারেনি। তবে সে দৃশ্যে আজও মুসলিম উম্মাহর অশ্রæ ঝরছে। মুহাররম মাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় সমৃদ্ধ। তবুও এই দিনে সর্বপ্রথমে ইমাম হুমাইন (রাঃ) তথা আহলে বাইআতদের কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিক শাহাদতের ঘটনা মুসলিম উম্মাহর সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে।

ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে তাদরে এই আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার শোকাবহ শাহাদতের ঘটনা সকলকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে যুগ যুগ ধরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here