ছবিতে কী দেখতে চান তাঁরা

10
ছবিতে কী দেখতে চান তাঁরা

আনপ্রেডিক্টেবল গল্প চাই সঙ্গে স্ট্রং অ্যান্টাগনিস্ট

স্টেরিওটাইপ প্রেডিক্টেবল গল্প আর দেখতে চাই না। সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের গল্প যা জানে, শুনে আসছে, সেগুলোই পর্দায় দেখে এসেছি এত দিন—সবই কমবেশি একই প্যাটার্নে তৈরি। এর বাইরে কি কিছু ভাবা যায় না? সিনেমা ইলিউশন তৈরি করতে পারে, স্ট্রং ক্যারেক্টার তৈরি করতে পারে। এ কারণেই সিনেমার ইমেজ ও চরিত্র আমাদের যুগ যুগ ধরে মনে থাকে।

Pop Ads

আমি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় স্ট্রং অ্যান্টাগনিস্ট দেখতে চাই। পাকিস্তানি হানাদার অফিসার হোক কিংবা রাজাকার-আলবদর—সবই একটা ছকে পড়ে আছে। ‘মুক্তি কিধার হ্যায়’, ‘লাড়কি লেকে আও’—চরিত্রগুলো এসব সংলাপেই ঘোরাফেরা করে। চরিত্রগুলো যদি বুদ্ধিদীপ্ত হয়, আরো চতুর ও আনপ্রেডিক্টেবল হয়—তখন চিত্রনাট্যে অনেক বাঁক আসে।

তাদের বিরুদ্ধে অসহায় বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক জয়ের গল্প আরো বেশি দাগ কাটবে দর্শক মনে। আরো বেশি মাহাত্ম্যপূর্ণ হবে।
সাধারণত দুই ধরনের যুদ্ধের ছবি হয়। একটা প্রত্যক্ষ যুদ্ধের গল্প—যেখানে যুদ্ধক্ষেত্র, অস্ত্রবাজি, গোলাগুলি উঠে আসে।

এসব গল্পের আঙ্গিক বড় হয়, ডিটেইলিং নিয়ে কাজ করতে হয়, আয়োজন হয় বিশাল, তাই বাজেটও বেশি প্রয়োজন হয়। আরেক ধরনের গল্প হয় যুদ্ধের আবহে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ না দেখিয়েও যুদ্ধকালীন সময়ের টেনশন, আশঙ্কা, ভয়াবহতা, দিনযাপনের গল্প দেখানো যায়। আমাকে বেশি টানে এ ধরনের গল্প। এ ধরনের গল্পে হয়তো বড় বাজেটের প্রয়োজন নেই, কিন্তু ঠিকভাবে লিখতে ও বানাতে পারলে এর আবেদন থাকে বহু যুগ।

আমাদের যুদ্ধের ছবিতে যুদ্ধ আছে, কিন্তু রাজনীতি ভীষণভাবে অনুপস্থিত থাকে। যুদ্ধকালীন সময়ের রাজনীতি, যুদ্ধের রাজনীতি, পেছনের রাজনীতি, বেঁচে থাকার রাজনীতি—এসব দরকার।

নির্মাতাদের গল্প বলায় সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিতে হবে। যে ন্যারেটিভ আমার সুবিধায় যায়, সেই ছবিই চলবে; আর যে ন্যারেটিভ আমার ভেতর অস্বস্তি তৈরি করে, সেই ছবি বানাতে দেব না—এই মনোভাব থেকে বের হতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ হতে দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গা, এটা সত্য। ন্যারেটিভ, কাউন্টার ন্যারেটিভের ভেতর দিয়ে যেমন প্রকৃত ইতিহাস উঠে আসে, তেমনি কোনো সিনেমাও শেষমেশ সিনেমা হয়ে ওঠে ন্যারেটিভ ও কাউন্টার ন্যারেটিভের ভেতর দিয়েই।

বীরত্ব ও সাহসিকতার গল্প সেভাবে আসেনি

মুক্তিযুদ্ধে অনেক ভালো ছবি হয়েছে, তবে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা আসেনি—বীরত্ব ও সাহসিকতার গল্প। শরণার্থীরা ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে নিরীহ মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছে, মেরে ফেলা হচ্ছে কিংবা নারীর সম্ভ্রমহানি—এসবই বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমরা যে শক্তি, বুদ্ধি আর সাহসের সঙ্গে যে বীরত্ব দেখিয়েছি, সেটা ফুটে ওঠেনি। বড় বা ছোট ছোট অপারেশনগুলো অত্যন্ত হিরোয়িক কায়দায় কমার্শিয়াল অ্যাপ্রোচে দেখানো যেতে পারত, কিন্তু হয়নি।

এই না হওয়ার কারণ সামগ্রিকভাবে বলতে পারব না, তবে আমি আমারটা বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের বীরত্ব নিয়ে ‘আকাশ যোদ্ধা’ ছবির পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু আমি পাঁচ বছর ঘুরেও ফান্ড তৈরি করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে কেউ বেশি টাকা খরচ করতে চান না, তাঁরা ভাবেন এই ধারার ছবি সরকারি অনুদান পাচ্ছে, অনুদান দিয়েই ছবি নির্মিত হবে। কিন্তু রাষ্ট্র যে অনুদান দেয় তাতে এই বড় পরিসরের ছবি বানানো সম্ভব নয়। আমার ছবির অনেকখানি পুঁজি উঠে আসে প্রডাক্ট প্রচারণা ও স্পন্সর দিয়ে, তারাও মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে আগ্রহী নয়, কারণ তাদের প্রডাক্ট দেখাতে পারবে না।

আমাদের গল্প নিয়ে বলিউডে বড় বাজেটের ‘পিপ্পা’ হয়, অথচ মাত্র আড়াই-তিন কোটি টাকার জন্য আমার ছবিটা বানাতে পারিনি। যে মানুষটিকে কেন্দ্র করে এই ছবির গবেষণা করেছিলাম, তিনিও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তাই আমার পাঁচ বছর ধরে লালন করা ‘আকাশ যোদ্ধা’ নির্মাণের ভাবনা বাদ দিয়েছি। এই ব্যর্থতা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।

অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে আমি আগ্রহী

বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক কিছুই এখনো পর্দায় উঠে আসেনি। একটা জনযুদ্ধের ঠিক পর পর নানা কারণে একদম ঠিকঠাকভাবে তা পর্দায় দেখানো সম্ভব হয় না। আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ভালো যে ছবিগুলো দেখি, সেগুলো নির্মিত হয়েছে ৫০-৬০ বছর পর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পেরিয়েছে, এখন সঠিক সময় ঠিকঠাকভাবে সিনেমা বানানোর। যেখানে অনেক অজানা ও সাহসিকতার গল্প দেখানো যাবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে অপারেশন জ্যাকপটের অংশ নিয়ে বেশি আগ্রহী, এর স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আপ্লুত হয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য এক গৌরবগাথা এই অপারেশন জ্যাকপট। যদিও ছবিটা নিয়ে এখনো আইনি লড়াই চলছে, জানি না বানাতে পারব কি না। তবে আমি আশা ছড়িনি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন পিতা-পুত্রের গল্প নিয়েও একটি ছবির স্ক্রিপ্ট করেছি। আমি টেলিভিশনে ‘পাপ-পুণ্য’, ‘ভয়’, ‘হারানের নাতজামাই’সহ কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাজ করেছিলাম, তখন শুট করতে গিয়ে কিছু ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।

নারীদের সংগ্রামী জীবন আরো চাই

মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে অভিনয় করা একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য গর্বের ব্যাপার। ‘দামাল’-এ অভিনয় করতে পেরে ভীষণভাবে আপ্লুত হয়েছিলাম। ছবিটা মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে নিয়ে হলেও আমার চরিত্রটি ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময়কার একজন নারীর সাহসের কথাই উঠে এসেছে। শ্রদ্ধেয় পান্না কায়সার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার ছবি ‘দিগন্তে ফুলের আগুন’, এখানে মুক্তিযুদ্ধ সময়কার একজন নারীর সংগ্রাম দেখানো হবে। আপাতত এর থেকে বেশি বলব না। মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে বাজেট খুব জরুরি, ‘দামাল’-এ আমরা ভালো বাজেট পেয়েছিলাম। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ছবিটা আমার খুব পছন্দের। সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন এক মায়ের জীবন দেখানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক নারীর বহু ত্যাগের গল্প আছে, সেগুলো আরো বিশদভাবে পর্দায় ফুটে উঠুক। সামনে কেউ না কেউ ঠিকই সেগুলো পর্দায় আনবেন।