নওগাঁর প্রায় ২শ’ বছরের ঐতিহাসিক  দুবলহাটি রাজবাড়িটি বিলুপ্তির পথে

শাফায়াত সজল, নওগাঁ : সৃষ্টি আর ধ্বংসেই এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত।  আবার কারো কারো দায়িত্বহীনতায় কালের গহব্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলো। এতে করে নতুন প্রজন্ম হারাচ্ছে তাদের ইতিহাস জানার অধিকার ও শুযোগ। মানুষের জীবনে বর্তমান যেমন গুরুত্ববহন করে ঠিক তেমনই সোনালী অতীতও অনুপ্রেরণা যোগায়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন। এসব ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজরিত স্থানসমূহ আমাদের আপন সত্ত্বাতেও আলোড়ন তোলে। জ্ঞানের ভান্ডার হয় আরো সমৃদ্ধ। তেমনি আলোড়ন জাগানো ঐতিহাসিক বহুল স্থানটি হলো নওগাঁর দুবলহাটি রাজবাড়ী। এই রাজবাড়িটি নওগাঁ শহর হতে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অযতœ ও অবহেলায় ২শ’ বছরের পুরনো এই রাজবাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। ১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণনাথ গভর্ণর  লর্ড কর্ণওয়ালিস এর কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪ শত  ৯৫ টাকা দিয়ে পত্তন নিয়ে এই রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। রাজা কৃষ্ণনাথ নিঃসন্তান হওয়ায় তার পরবর্তীতে ১৮৫৩ সালে রাজত্বভার গ্রহণ করেন তার নাতি রাজা হরনাথ রায়। রাজা হরনাথের আমলে দুবলহাটির রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি দুবলহাটি রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজ প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন। ১৮৬৪ সালে রাজ পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটির নাম রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়।  ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় ভারতে চলে যান। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে যায় সুবিশাল অট্টালিকা। রাজবাড়ির মূল ফটকে রোমান স্টাইলের স্তম্বগুলো রাজাদের দুরুচীর পরিচয় বহন করে। রাজবাড়িতে সবমিলিয়ে ৭টি আঙিনা এবং প্রায় ৩০০টি ঘর ছিল। প্রাসাদের ভেতরের ভবন গুলো কোনটি তিনতলা আবার কোনটি চারতলা বিশিষ্ট। প্রাসাদে ছিল রাজরাজেশ্বরী মন্দির যেখানে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো প্রতি সন্ধ্যায়। শোনা যেতো শঙ্খের ধ্বনি যা কালের বির্বতনে আজ জনমানবহীন এক শশ্বানে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়ির পিছন অংশে এখনো সান বাধানো একটি কুয়া বা কূপের অস্তিত্ব রয়েছে। যা বর্তমানে কলাগাছের বাগানের মধ্য ভরাট হওয়া কূপ হয়ে গেছে।  রাজবাড়ির সামনের অংশে আছে "গোবিন্দ পুকুর"। পুকুরে ঘাটে যাবার সময় চোখে পড়বে দুইপাশে ২টি মন্দির।  পুকুরটির ২ টি সান বাধানো ঘাট। একটি রাজবাড়ির সামনের ঘাট এবং অপরটি উত্তরপাশ লাগোয়া। যার পাশে ছিল স্থানীয় এলাকায় প্রচলিত “গান বাড়ি বা জলসা বাড়ি”নামক ভবন। যেখানে অন্যান্য জমিদার কিংবা অতিথিদের গান বাজনা, নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন মনোরঞ্জনের আয়োজন করা হতো। জলসা ঘরটি এখন স্থানীয় হিন্দু পরিবারদের দখলে। দেখলে বুঝারই উপায় নেই এইখানে একসময় দেশ বিদেশের নামকরা গায়ক, গায়িকা, নৃত্যশিল্পীরা তাদের শিল্পকলা প্রদর্শন করতো !! নওগাঁর সাবেক এমপি মরহুম আব্দুল জলিল কর্তৃক এই ভবনের উন্নয়ন সাধন করে এটিকে হাসপাতাল তৈরীর চেষ্টা করা হলেও এই কার্যক্রম পরিনতি পায়নি। জলসা বাড়ি’র অনতিদূরে আছে কালী মন্দির যা এখন আগাছা জঞ্জালে পরিপূর্ণ। কালী মন্দির হতে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে বয়েছে রাজার অবসর যাপনের জন্য “বাগানবাড়ি”। স্থানীয় লোকেরা এটিকে ছোট রাজবাড়ি বলেই বেশি চিনে। বাগানবাড়িতে এখন দুটি পরিবার বসতি স্থাপন করেছে। এক সময়  যে অনেক জৌলুস ছিলো তৎকালীন রাজাদের তা বর্তমানেও রাজবাড়ির ধংসাবশেষ দেখে বোঝা যায় অনায়াসেই। রাজ্যের বিস্তারে এলাকায় ব্যাপক প্রভাব ছিলো এই রাজ পরিবারের। আর সেইজন্যেই হরনাথ রায় চৌধুরী "রাজা" খেতাব পেয়েছিলেন। এর আগের পূর্ব পুরুষরা মোগলদের দেয়া জমিদার খেতাবে ভূষিত ছিলেন। দুবলাহাটি  রাজপরিবারের গিণেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভূক্ত ২২ কাহন কৈ মাছ দিয়ে রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে রাজবাড়ির মূল ফটকের পাশে ছিন্নমূল বাবুর পরিবারের আবাস। রাজবাড়ির দু'তলায় তিন-চার বছর ধরে দখল করে কবুতর পালন কাজ করছেন স্থানীয় যুবক আলম। জমিদারির গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার রাজবাড়িকে সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নেয়।  প্রতœতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্বভার গ্রহন করলেও অদ্যাবধি এর সুরক্ষা বা সংস্কারের তেমন কোন প্রকার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পরে দিনে দিনে রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যায়। মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকায় অনেকেরই বাড়ি তৈরী করার কথাও প্রচলিত রয়েছে। অবহেলা অযতেœ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুবলহাটি রাজবাড়িতে এখন প্রায় সব সময়ই চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। অবাধে বসছে মদ, জুয়া, গাঁজার আড্ডা। রাজবাড়ী হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত অসামাজিক কার্য কলাপের কেন্দ্র বিন্দু। কেউ দেখার নেই। কারোরই যেন মাথা ব্যাথা নেই। যার ফলশ্রতিতে বর্তমানে ধ্বংসের দাঁড় প্রান্তে দুবলহাটি রাজবাড়ি। ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই রাজবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

শাফায়াত সজল, নওগাঁ : সৃষ্টি আর ধ্বংসেই এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত।  আবার কারো কারো দায়িত্বহীনতায় কালের গহব্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলো। এতে করে নতুন প্রজন্ম হারাচ্ছে তাদের ইতিহাস জানার অধিকার ও শুযোগ। মানুষের জীবনে বর্তমান যেমন গুরুত্ববহন করে ঠিক তেমনই সোনালী অতীতও অনুপ্রেরণা যোগায়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন।

এসব ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজরিত স্থানসমূহ আমাদের আপন সত্ত্বাতেও আলোড়ন তোলে। জ্ঞানের ভান্ডার হয় আরো সমৃদ্ধ। তেমনি আলোড়ন জাগানো ঐতিহাসিক বহুল স্থানটি হলো নওগাঁর দুবলহাটি রাজবাড়ী। এই রাজবাড়িটি নওগাঁ শহর হতে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অযতœ ও অবহেলায় ২শ’ বছরের পুরনো এই রাজবাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। ১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণনাথ গভর্ণর  লর্ড কর্ণওয়ালিস এর কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪ শত  ৯৫ টাকা দিয়ে পত্তন নিয়ে এই রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন।

Pop Ads

রাজা কৃষ্ণনাথ নিঃসন্তান হওয়ায় তার পরবর্তীতে ১৮৫৩ সালে রাজত্বভার গ্রহণ করেন তার নাতি রাজা হরনাথ রায়। রাজা হরনাথের আমলে দুবলহাটির রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি দুবলহাটি রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজ প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন। ১৮৬৪ সালে রাজ পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটির নাম রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় ভারতে চলে যান। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে যায় সুবিশাল অট্টালিকা। রাজবাড়ির মূল ফটকে রোমান স্টাইলের স্তম্বগুলো রাজাদের দুরুচীর পরিচয় বহন করে। রাজবাড়িতে সবমিলিয়ে ৭টি আঙিনা এবং প্রায় ৩০০টি ঘর ছিল। প্রাসাদের ভেতরের ভবন গুলো কোনটি তিনতলা আবার কোনটি চারতলা বিশিষ্ট।

প্রাসাদে ছিল রাজরাজেশ্বরী মন্দির যেখানে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো প্রতি সন্ধ্যায়। শোনা যেতো শঙ্খের ধ্বনি যা কালের বির্বতনে আজ জনমানবহীন এক শশ্বানে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়ির পিছন অংশে এখনো সান বাধানো একটি কুয়া বা কূপের অস্তিত্ব রয়েছে। যা বর্তমানে কলাগাছের বাগানের মধ্য ভরাট হওয়া কূপ হয়ে গেছে।  রাজবাড়ির সামনের অংশে আছে “গোবিন্দ পুকুর”। পুকুরে ঘাটে যাবার সময় চোখে পড়বে দুইপাশে ২টি মন্দির।

পুকুরটির ২ টি সান বাধানো ঘাট। একটি রাজবাড়ির সামনের ঘাট এবং অপরটি উত্তরপাশ লাগোয়া। যার পাশে ছিল স্থানীয় এলাকায় প্রচলিত “গান বাড়ি বা জলসা বাড়ি”নামক ভবন। যেখানে অন্যান্য জমিদার কিংবা অতিথিদের গান বাজনা, নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন মনোরঞ্জনের আয়োজন করা হতো। জলসা ঘরটি এখন স্থানীয় হিন্দু পরিবারদের দখলে। দেখলে বুঝারই উপায় নেই এইখানে একসময় দেশ বিদেশের নামকরা গায়ক, গায়িকা, নৃত্যশিল্পীরা তাদের শিল্পকলা প্রদর্শন করতো !!

নওগাঁর সাবেক এমপি মরহুম আব্দুল জলিল কর্তৃক এই ভবনের উন্নয়ন সাধন করে এটিকে হাসপাতাল তৈরীর চেষ্টা করা হলেও এই কার্যক্রম পরিনতি পায়নি। জলসা বাড়ি’র অনতিদূরে আছে কালী মন্দির যা এখন আগাছা জঞ্জালে পরিপূর্ণ। কালী মন্দির হতে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে বয়েছে রাজার অবসর যাপনের জন্য “বাগানবাড়ি”। স্থানীয় লোকেরা এটিকে ছোট রাজবাড়ি বলেই বেশি চিনে।

বাগানবাড়িতে এখন দুটি পরিবার বসতি স্থাপন করেছে। এক সময়  যে অনেক জৌলুস ছিলো তৎকালীন রাজাদের তা বর্তমানেও রাজবাড়ির ধংসাবশেষ দেখে বোঝা যায় অনায়াসেই। রাজ্যের বিস্তারে এলাকায় ব্যাপক প্রভাব ছিলো এই রাজ পরিবারের। আর সেইজন্যেই হরনাথ রায় চৌধুরী “রাজা” খেতাব পেয়েছিলেন। এর আগের পূর্ব পুরুষরা মোগলদের দেয়া জমিদার খেতাবে ভূষিত ছিলেন।

দুবলাহাটি  রাজপরিবারের গিণেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভূক্ত ২২ কাহন কৈ মাছ দিয়ে রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে রাজবাড়ির মূল ফটকের পাশে ছিন্নমূল বাবুর পরিবারের আবাস। রাজবাড়ির দু’তলায় তিন-চার বছর ধরে দখল করে কবুতর পালন কাজ করছেন স্থানীয় যুবক আলম। জমিদারির গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার রাজবাড়িকে সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নেয়।

প্রত্তনত্ত্ব বিভাগ দায়িত্বভার গ্রহন করলেও অদ্যাবধি এর সুরক্ষা বা সংস্কারের তেমন কোন প্রকার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পরে দিনে দিনে রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যায়। মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকায় অনেকেরই বাড়ি তৈরী করার কথাও প্রচলিত রয়েছে।

অবহেলা অযতেœ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুবলহাটি রাজবাড়িতে এখন প্রায় সব সময়ই চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। অবাধে বসছে মদ, জুয়া, গাঁজার আড্ডা। রাজবাড়ী হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত অসামাজিক কার্য কলাপের কেন্দ্র বিন্দু। কেউ দেখার নেই। কারোরই যেন মাথা ব্যাথা নেই। যার ফলশ্রতিতে বর্তমানে ধ্বংসের দাঁড় প্রান্তে দুবলহাটি রাজবাড়ি। ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই রাজবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।