পরমাণুবাদের স্বর্ণযুগ

5
পরমাণুবাদের স্বর্ণযুগ

মধ্যযুগে রবার্ট বয়েল আর রেনে দেকার্তের মতো বিজ্ঞানীরা বস্তুর ভৌত গঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিষিদ্ধ পরমাণু ধারণায় ফিরে গেলেন। তবে সে যাওয়াতেও বেশি জোর ছিল না। তারপর তো আইজ্যাক নিউটনের আবির্ভাব আর পদার্থবিদ্যার স্বর্ণযুগের শুরু।

নিউটনের ক্ষেত্র ব্যাপক।

Pop Ads

তিনি গ্রহ-নক্ষত্রের ব্যাপারে অসামান্য সব কাজ করে গেছেন। কাজ করে গেছেন, গণিত, আলোকবিদ্যা, তাপবিদ্যার ওপরে। গ্যাসের গতিতত্ত্বও, বস্তুর ভৌত গঠন নিয়ে গবেষণাতেও নিউটন অগ্রগণ্য ছিলেন। তবে নিউটন ছিলেন গভীর ধর্মবিশ্বাসী মানুষ।

তাই বলে গোঁড়া-অন্ধ ধার্মিকদের সাথে তাঁকে মেলানো যাবে না। তবু তিনি ‘পরমাণু’কে সেইভাবে তার লেখাতে তুলে ধরেননি। কারণ সেটা সরাসরি খ্রিস্ট ধর্ম বিরোধী হয়ে যেতে পারে। তবে পরমাণু ধারণায় অবিশ্বাসীও ছিলেন না নিউটন।

নিউটন পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের অগ্রদূত। গ্যালিলিওর মতো। কিংবা গ্যালিলিওর চেয়ে বেশিই। কত রকম যন্ত্রপাতি তৈরি করেছেন, কত রকম পরীক্ষা করে দেখেছেন! সেকালে তাঁর মতো করে বিজ্ঞানকে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মধ্যেমে যাচাই করার লোক খুব কমই ছিল।
অ্যারিস্টোটলের মতো শুধু নিজের ভাবনাটাকেই প্রকৃতির নিয়ম বলে চালানোর মতো লোক ছিলেন না নিউটন।

তাই পরমাণু ধারণাকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। কণা ধারণায় তার আস্থা ছিল প্রবল। আলোকেও তিনি কণা হিসেবে দেখতেন।
তবে নিউটনের ‘কণা’ ধারণা আধুনিক ‘পরমাণু’ ধারণার চেয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম ছিল। তিনি ‘কণা’দের আকর্ষণী ও বিকর্ষণী বল আছে এটাই শুধু মনে করতেন। যেমন আলোর প্রতিফলনের জন্য তিনি আলোর কণিকাদের বিকর্ষণী ক্ষমতাকেই দায়ী করেছেন। তেমনি প্রতিসরণকে মনে করতেন আলোর কণাদের আকর্ষণী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু একই কণা একই বস্তুর ওপর পড়লে কিছু আকর্ষণকারী কিছু বিকর্ষণকারী ধর্ম কেন দেখায়, সে ব্যাখ্যা নিউটনের কাছে ছিল না।

গ্রহ-নক্ষত্রের চলাচলের ব্যাপারে খ্রীস্ট ধর্ম ও পোপেরা যত বেশি কঠোরতা দেখিয়েছেন ততো বেশি কঠোরতা দেখাননি পরমাণুবাদীদের প্রতি। আসলে গ্রহ-নক্ষত্রদের গতিপ্রকৃতির ব্যাপারে মধ্যযুগের বিজ্ঞানীদের যতটা বেশ স্বচ্ছ ধারণা ছিল, পরমাণু সম্পর্কে অতটা স্বচ্ছ ধারণা তাঁরা করতে পারেননি। ছিল না পরমাণুবাদের পক্ষে আকাট্য প্রমাণও। পরমাণু নিয়ে বিজ্ঞানীরা তাই জোর গলায় কথা বলেননি। তারপরও পরমাণুবাদ রেহায় পায়নি চার্চ-পোপের সাজা থেকে। নিউটনের যুগেরই এক ফরাসী দার্শনিক ছিলেন। পিয়েরে গাসেন্ডি। লুক্রেটিয়াসের বই-ই মূলত পরমাণুবাদে অনুপ্রাণীত করে গাশোন্ডিকে। তিনি পরমাণুবাদ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেন। পরমাণুবাদ প্রচারের জন্য ধর্মগুরুরা তাঁকে নির্যাতন করেছিল।

গ্যাসেন্ডির লেখা বইয়ের অনুপ্রাণীত হন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল। গ্যাসের চাপ বিষয়ক একটা বিখ্যাত সূত্র আছে। সেটার নাম বয়েলের সূত্র। একটা ‘ট’ আকৃতির কাচনলে গ্যাস ও পারদ ঢুকিয়ে তিনি পরীক্ষা চালান। দেখান, বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক চাপে গ্যাসের আয়তন একরকম। পারদের চাপ বাড়লে গ্যাসের চাপ আরেকরকম। পারদের চাপ ধীরে ধীরে বাড়লে গ্যাসের আয়তনও কমতে থাকে। একই পরিমাণ গ্যাস, শুধুমাত্র চাপ কমবেশি হওয়ার কারণে আয়তন বাড়ছে-কমছে কেন? তাহলে কি গ্যাসীয় পদার্থগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোনো কণা দিয়ে তৈরি? সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার মধ্যে নিশ্চয়ই ফাঁকা জায়গা আছে। চাপ বাড়ালে ফাঁকা জায়গাগুলো নিশ্চয়ই কমে যায়। তার ফলে কণাগুলো পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে। বয়েলের অনুমান ঠিক ছিল। তিনি ওই ঘটনার পরে চাপ ও গ্যাসের আয়তনের সম্পর্ক নির্ণয়ের একটি সূত্র আবিষ্কার।

অতএব ক্ষুদ্র কণা সম্পর্কে বয়েল নিশ্চিত হলেন। নিশ্চিত হলেন, ডেমোক্রিটাস যে অবিভাজ্য কণা অ্যাটোমের কথা বলেছিলেন গ্যাসীয় পদার্থ তার সমষ্টি। কঠিন বস্তুকে তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে তরল ও গ্যাসীয় বস্তুতে পরিণত করা যায় সহজেই।

কঠিন ও তরলও নিশ্চিতভাবে পরমাণু দিয়ে তৈরি। তবে গ্যাসের তুলনায় তরলের পরমাণুগুলোর মধ্যে ফাঁক কম থাকে। তরলের তুলনায় কঠিন পদার্থের পরমাণুগুলোর মধ্যে ফাঁক থাকে না বললেই চলে। তাই অল্প স্বল্প চাপে কঠিন পদার্থের আয়তনের তেমন পরিবর্তন হয় না। বয়েলের পরীক্ষাই পরমাণুবাদ তত্ত্বের ওপর প্রথম পরীক্ষা। অবশ্য এই ধারণায় ত্রুটি আছে। আমরা এখন জানি, যেটাকে বয়েল পরমাণু করতেন, আসলে তা ছিল পদার্থের অণু। তবে অণু-পরমাণুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়েছে অনেক পরে।

বয়েল পরমাণুর সঠিক ব্যাখ্যাটা হয়তো দিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু তিনিই উন্মুক্ত করে গিয়েছিলেন পরমাণু চর্চার পথ। এরপর থেকে আর কোনো বিজ্ঞানীকে পরমাণুবাদ চর্চার জন্য বিরোধের মুখে পড়তে হয়নি, শাস্তিও পেতে হয়নি। বয়েলের পথ ধরেন জোসেফ লুই প্রাউসট, জ্যাকব বার্জেলিয়াস, জন ডালটন, অ্যামাদিও অ্যাভোগেড্রো, রবার্ট ব্রাউনের কাঁধে চেপে পূর্ণতা পথে এগিয়ে যায় পরমাণুবাদ। ১৯০৫ সালে মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ‘ব্রাউনীর গতি’র ব্যাখ্যা দিয়ে পরমাণু জগতের নিষিদ্ধ দেয়াল পুরোপুরি ভেঙে ফেলেন।