মুতার যুদ্ধের ইবরতি ওয়াকিয়া

মুতার যুদ্ধের ইবরতি ওয়াকিয়া। প্রতিকী-ছবি

আলহাজ¦ হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুল হক

সুপ্রভাত বগুড়া (ধর্ম ও জীবন): ৮ম হিজরীর জুমাদাল উলা মাসে তথা ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ আগষ্টে শামদেশের মুতা নামক স্থানে রোমকদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের কারণ হলো, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত হারিস ইবনে উমায়ের (রাঃ)-কে ইসলামের দাওয়াত পত্র দিয়ে বসরায় প্রেরণ করেন। বসরার গভর্নর-শাসক শুরাহবিল ইবনে আমর আল-গাসসানী গোটা পৃথিবীর স্বীকৃত-প্রতিষ্ঠিত আইন লঙ্ঘন করে হুজুর (সাঃ)-এর দূতকে নির্মমভাবে শহীদ করে। আর বার্তাবাহক বা রাষ্ট্রদূত সম্পর্কে পুরো পৃথিবীর নিয়ম এখনো এটিই রয়েছে এবং সে যুগেও এটিই ছিল যে, তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে হবে।

Pop Ads

এজন্যে হুজুর (সাঃ) স্থানটি দূরবর্তী হওয়া সত্তে¡ও বিষয়টি প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে শাস্তিস্বরূপ তিনি হাজার বাহিনীর একটি সেনাদল তথায় প্রেরণ করেন। বাহিনী প্রেরণকালে হুজুর (সাঃ) অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ বিশেষ অসিয়ত করেন। যেমনঃ- মহিলা, শিশু ও বুড়োদের হত্যা করবে না, বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলবে না, কোনো গাছ কাটবে না, ইত্যাদি। হুজুর (সাঃ) শুরাহবিলকে শায়েস্তা করে এমন এক বিধানের সহযোগিতা করেছেন, যার উপর বিশ্ব-শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভরশীল ছিল।

মহানবী (সাঃ) হযরত যায়েদ ইবনে হারেসাকে এই সৈন্যবাহিনীর সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। বাহিনী প্রেরণকালে তিনি এই অসিয়তও করেছিলেন যে, ‘যদি যায়েদ (রাঃ) যুদ্ধে শহীদ হয়ে যায়, তবে জাফর ইবনে আবু তালিব (রাঃ) আমীর হবে, যদি সেও শহীদ হয়ে যায়, তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রাঃ) যুদ্ধের পতাকা নেবে’। যখন মুসলিম বাহিনী মাআন নামক স্থানে উপনীত হলো, তখন সেনাদল সংবাদ পেল যে, তাদেরকে আনুমানিক দেড় লক্ষ সৈন্যবাহিনীর মোকাবেলা করতে হবে। এমন খবরে মুসলমানরা অপ্রস্তুতবোধ করলেন এবং দুদিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে পরিস্থিতি অবলোকন করতে লাগলেন। অতঃপর পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত হলো যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সাহায্যার্থে আরও অধিক সৈন্য প্রেরণের কথা লেখা হোক, নতুবা তিনি যে হুকুম দিবেন, সে অনুসারেই অগ্রসর হওয়া যাবে।

তখন আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রাঃ) এক তেজোদীপ্ত ভাষণ দিলেন। বললেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা শাহাদত কামনা করে ঘর থেকে বের হয়েছ। আর আজ সেই শাহাদতকেই তোমাদের কাছে অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে! আমরা শক্তি ও জনসংখ্যার ভরসায় যুদ্ধ করি না। আমাদের লড়াই হচ্ছে দীনের জন্য। দুটি কল্যাণের একটি তো আমরা অবশ্যই লাভ করবো। হয় বিজয়, নয়তো শাহাদত। বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ। সুতরাং কিসের শংকা’। তাঁর এমন বক্তব্যে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে প্রেরণা জাগ্রত হলো। সকলেই একসাথে বলে উঠলো, আব্দুল্লাহ যথার্থ বলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা যুদ্ধের জন্যে বেরিয়ে পড়লেন। শুরু হলো ভীষণ যুদ্ধ। প্রথমে যায়েদ (রাঃ)-এর হাতে পতাকা ছিল। তিনি বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে গেলেন। তারপর জাফর (রাঃ) পতাকা নিলেন। তাঁর ডান হাত কেটে দেওয়া হলো। তিনি এবার বাম হাতে পতাকা ধরলেন।

যখন সে হাতটি শত্রæরা কেটে ফেললো, তখন দুই বাহু একত্র করে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে ইসলামী পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে রাখলেন। এভাবে প্রাণপণে যুদ্ধ করতে করতে তিনিও শহীদ হয়ে গেলেন। এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহ (রাঃ) যুদ্ধের পতাকা ধরলেন। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে তিনিও শাহাদত বরণ করলেন। এবার মুসলিম বাহিনীর সকলে পরামর্শ করে সর্বসম্মতিক্রমে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ)-কে নেতৃত্বে বরণ করে নিলেন। আল্লাহর তরবারি উপাধিপ্রাপ্ত খালেদ (রাঃ)-তুমুল লাড়াইয়ে প্রবৃত্ত হলেন।

এ যুদ্ধে মাত্র ১২জন মুসলমান শহীদ হন। এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে মুসলমানদের জয় সূচিত হয়। তবে ইবনে ইসহাকের মতে, মুতার যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার পূর্বেই উভয় দল স্থান ত্যাগ করেন। বুখারীতে বর্ণিত, খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) বলেন, মুতার যুদ্ধে আমার হাতে একে একে নয়টি তলোয়ার ভেঙ্গে যায়। অবশেষে কেবল একটি ইয়ামানী তলোয়ারই ছিল আমার শেষ সম্বল। হযরত আনাছ (রাঃ) বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একটি মুজেযা প্রকাশ পায়।

তাহলো; তিনি মুতার যুদ্ধের ফলাফল সাহাবীদের এমনভাবে দিচ্ছিলেন যেন তিনি সবকিছু দেখছেন (বুখারী)। যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে যখন ইউলা ইবনে উমাইয়া (রাঃ) মদিনায় এলেন, তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, চাইলে তুমি আমাদেরকে যুদ্ধের খবর দিতে পার আর তুমি চাইলে আমিও তোমাদেরকে সংবাদ শুনিয়ে দিতে পারি। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তাহলে আপনিই শুনান! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন যুদ্ধের বিবরণ শুনিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, আপনি তো হুবহু বিবরণ শুনিয়ে দিয়েছেন। একটি শব্দও বাদ যায়নি। (সূত্রঃ- সীরাত গ্রন্থ)