রমজানের আগেই বাজার চড়া

9
রমজানের আগেই বাজার চড়া

ডলার-সংকট, এলসি জটিলতা, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা
বাজার স্থিতিশীল রাখতে সব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী
ত্রুটিপূর্ণ বিপণন ব্যবস্থায় মূল্য বৃদ্ধি পায়: ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি
কিছু মধ্যস্বত্বভোগী কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে: প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী
কোনোভাবেই যেন স্বস্তি ফিরছে না নিত্যপণ্যের বাজারে। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে মাছ, ডিম, সবজি সবকিছুর দামই বাড়ছে। অথচ আর মাত্র দেড় মাস পরই শুরু হচ্ছে রমজান। এসব পণ্যের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীরা ডলার-সংকট ও ঋণপত্র খোলা নিয়ে জটিলতা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবসহ বিভিন্ন সমস্যাকে দায়ী করেছেন। তবে ভোক্তারা বলেছেন, প্রতি বছর রমজান শুরু হওয়ার আগেই এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এই সিন্ডিকেটের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে ভোক্তারা।

সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চাল, পামঅয়েল, মুগ ডাল, মাছ, ডিমসহ অন্তত ১০টি পণ্যের দাম বেড়েছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর কাওরানবাজার, তুরাগ এলাকার নতুন বাজার ও শান্তিনগরবাজারসহ কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়েও বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ার এ তথ্য পাওয়া গেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে, এমন পণ্যের মধ্যে প্রতি কেজি মুগ ডালে ২৫ টাকা বেড়ে ১২৫ থেকে ১৭০ টাকা, ছোলা ৫ টাকা বেড়ে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা, মোটা চালে ২ টাকা বেড়ে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা, খোলা সাদা আটায় ৩ টাকা বেড়ে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, দেশি রসুনে ২০ টাকা বেড়ে ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা, দেশি পেঁয়াজে ১০ টাকা বেড়ে ৯০ থেকে ১০০ টাকা, শুকনা মরিচে ৩০ টাকা বেড়ে ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা, হলুদে ২০ টাকা বেড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, দারুচিনিতে ৫০ টাকা বেড়ে ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি রুই মাছে ২০ টাকা বেড়ে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, খাসির মাংস ৫০ টাকা বেড়ে ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকা, দেশি মুরগি ২০ টাকা বেড়ে ৫২০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

Pop Ads

গত প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় গরুর মাংসের দামে কিছুটা হলেও স্বস্তি এসেছিল। সেই স্বস্তিও এখন মিলিয়ে যাচ্ছে। বাড়তে শুরু করেছে গরুর মাংসের দামও। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি গরুর মাংসে ৫০ টাকা বেড়ে ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে ডিমেরও। প্রতি হালি ফার্মের ডিমে ২ টাকা বেড়ে গতকাল বাজারে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া, ভরা মৌসুমেও এখন প্রায় সব ধরনের সবজির দামই চড়া। এ অবস্থায় ভোক্তারা রীতিমতো অসহায়। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে।

দেশের হাট-বাজারগুলোতে ধান, চালের ভালো সরবরাহ। কিন্তু তারপরও চালের দাম বেশি। গত মাসে কেজিতে এক লাফে প্রতি কেজি চালে ২ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। নতুন করে দাম আর না বাড়লেও বাড়তি দাম সেভাবে কমেনি। গত বৃহস্পতিবার ‘চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে করণীয়’ বিষয়ে রাজশাহীতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য নয়। হঠাৎ দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করার অপচেষ্টা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।

আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, বাজারে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি নেই। কিন্তু কিছু মধ্যস্বত্বভোগী আছে, যারা কারসাজি করে। তাদের কৃত্রিম সংকটের কারণে আমরা বিপদে পড়ি। এদের চিহ্নিত করে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। লাইসেন্স বাতিল করা হবে, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ছাড়পত্র বন্ধ করা হবে। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, রমজানে আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি, গত বছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৮টি পণ্যের যত এলসি হয়েছিল, এবার তার থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি এলসি হয়েছে। এলসি ওপেন করতে কোনো সমস্যা নেই। পণ্যগুলো সময়মতো দেশে এসে পৌঁছাবে বলে আশা করছি। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী সমস্যা না করলে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, আমাদের ত্রুটিপূর্ণ বিপণন ব্যবস্থার কারণে একই পণ্য বিভিন্ন হাতবদলের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি ব্যবসায়ীদের ক্রয়-বিক্রয়ে বাধ্যতামূলক পাকা রশিদ সংরক্ষণ করা এবং ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রয় করার কথা বলেছেন।

রমজানে যে পণ্যগুলোর চড়া দাম ভোক্তাদের বেশি ভোগায়। এর মধ্যে তেল ও চিনি অন্যতম। এ প্রসঙ্গে ভোক্তার মহাপরিচালক জানান, সয়াবিন তেল ও চিনির মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে অধিদপ্তর কর্তৃক রিফাইনারি থেকে পরিবেশক পর্যায় পর্যন্ত পণ্য দুটির মজুত পরিস্থিতি জানতে একটি অ্যাপস তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে এসব পণ্যের অবৈধ মজুত শনাক্ত এবং এর সঙ্গে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে।

বাজারে আমদানিকৃত নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে নানা উদ্যোগ

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ডলার-সংকট ও জটিলতার প্রভাব এড়াতে ধারে আট পণ্য আমদানির সুযোগ রেখে গত ১১ জানুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ। পণ্যগুলো হলো ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর। আমদানির অভাবে পণ্যগুলোর বাজার যাতে অস্থিতিশীল না হয়ে ওঠে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করা যাবে। এ সুবিধা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলবে। এছাড়া, ভোজ্য তেল, চিনি ও খেজুরের ওপর আরোপিত শুল্ক-কর কমানোর অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চিনি ও পেঁয়াজের ওপর থেকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিমধ্যে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে দাম বাড়বে না।