থাইল্যান্ড রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন ২১ বছর বয়সী এক ছাত্রী !

থাইল্যান্ড রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন ২১ বছর বয়সী এক ছাত্রী !

সুপ্রভাত বগুড়া (আন্তর্জাতিক): থাইল্যান্ডে গতকাল বুধবার হাজারো বিক্ষোভকারী রাজধানীতে জড়ো হয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান-ওচার পদত্যাগ, একইসঙ্গে রাজার ক্ষমতা খর্ব করার দাবি জানানো হয়। এরপরই জরুরি অবস্থা জারি করেছে দেশটির সরকার। সরকার বিরোধী আন্দোলন এই পর্যায়ে নিয়ে আসার মূলে রয়েছে ২১ বছর বয়সী এক ছাত্রী। গত আগস্ট মাসে থাইল্যান্ডের এক মঞ্চে বেশ ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ান এবং রাজতন্ত্রের প্রতি খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন ২১ বছর বয়সী ছাত্রী পানুসায়া সিথিজিরাওয়াত্তানাকুল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর করতালির মধ্যে দিয়ে ওই মঞ্চে পানুসায়া দেশটির রাজতন্ত্রের সংস্কারের লক্ষ্যে যে দশ দফা দাবি তুলে ধরেছিলেন, তা এখন দেশটিতে বহুল আলোচিত ও বিখ্যাত দশ-দফা ম্যানিফেস্টো নামে পরিচিত হয়ে গেছে। তার ওই পদক্ষেপ ছিল খুবই সাহসী ও অবাক করে দেয়ার মত। থাইল্যান্ডে জন্মের পর থেকে প্রত্যেককে শিখতে হয় কীভাবে রাজতন্ত্রকে ভালবাসতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে এবং থাই রাজপরিবারের বিরুদ্ধে কিছু বললে তার পরিণতি কী হতে পারে।

Pop Ads

পৃথিবীতে খুব কমই দেশই আছে যেখানে রাজপরিবারকে অসম্মান করার জন্য আইন আছে। থাই আইনে রাজা, রানি, রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বা রাজ দায়িত্ব পালনকারী কারো সমালোচনা করার শাস্তি ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। এ সত্ত্বেও গত কয়েক মাসে থাইল্যান্ড জুড়ে চলছে গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভ। আর এই বিক্ষোভের কেন্দ্রে আছেন পানাসুয়ার মত শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনে আটককৃতদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভের সময় তিন আঙুলের অভিবাদন জানানো একটি ব্যানার তুলে ধরেন এক বিক্ষোভকারী।  এরপর থেকেই তিন আঙুলের অভিবাদন এখন আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

মঞ্চ থেকে জনতার উদ্দেশ্যে পানাসুয়া বললেন: ‘সব মানুষের রক্ত লাল। আমরা আলাদা নই। এই পৃথিবীতে কেউ নীল রক্ত নিয়ে জন্মায়নি। কেউ হয়ত বেশি ভাল ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে। কিন্তু কেউ কারো থেকে বেশি শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে জন্মায়নি।’ পানুসায়ার ওই বক্তৃতা নিয়ে হৈচৈ সৃষ্টি হয়েছিল। মুক্তমনা শিক্ষাবিদরা তাকে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, রাজতন্ত্রপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো নিন্দায় ফেটে পড়েছিল, আর থাই জনগণ এমন বক্তব্য বিশ্বাসই করতে পারছিল না।

ওই সমাবেশের কয়েকদিন পর রাজতন্ত্র সমর্থকদের ফেসবুক পেজ, পানুসায়ার বিরুদ্ধে আক্রমণে সোচ্চার হয়ে ওঠে। কেউ কেউ অভিযোগ করে রিপাবলিকান রাজনীতিকরা তাকে দিয়ে এসব করাচ্ছে। পানুসায়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। পানুসায়া বলছেন, ‘তার মনে আছে তিনি যখন ছোট ছিলেন তখনও থাই জীবনে রাজপরিবারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করতেন তিনি। তার মনে আছে খুব গরমের এক দিনের একটি ঘটনা, একজন কর্মকর্তা তাদের বাসার দরোজায় কড়া নেড়ে তার পরিবারকে বলেছিল বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তার ফুটপাতে গিয়ে বসতে, কারণ রাস্তা দিয়ে কিছু সময়ের মধ্যে রাজার গাড়িবহর যাবে।’

‘কেন গাড়িবহর দেখতে চড়া রোদে আমাদের আধ ঘন্টা বসে থাকতে হবে? আমার মাথায়ই আসেনি কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে। আমি বেরিয়ে অপেক্ষমান জনতার সাথে যোগ দিইনি।’ তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট পানুসায়া। অল্প বয়স থেকেই রাজনীতিতে তার আগ্রহ ছিল। যখন হাই স্কুলে পড়তেন, তখন অবসর সময়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে রাজনীতি আলোচনা করে তিনি সবচেয়ে বেশি মজা পেতেন। ২০১৪ সালে যখন একটা অভ্যুত্থান হয়, তার বাবা তাকে এনিয়ে আরও জানতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। পরিবারে একমাত্র তার বাবাই সে সময় রাজনীতি সচেতন ছিলেন।

তবে পানুসায়া ছোটবেলায় লাজুক ছিলেন এবং স্কুলে বড়দের হম্বিতম্বিতে তিনি মুখচোরা থাকতেন। একটা শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচিতে আমেরিকায় পাঁচ মাস কাটানোর মধ্যে দিয়ে তিনি আমূল বদলে যান। এ সম্পর্কে পানুসায়া বলেন, ‘আমি দেশে ফিরে আসি অন্য মানুষ হয়ে। আমি তখন কথা বলতে বা কিছু করতে ভয় পেতাম না।’ প্রথম সারির বিখ্যাত থাম্মাসাত ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর তিনি রাজনৈতিকভাবে ক্রমশ আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। দুবছর আগে তিনি ‘ডোম রেভল্যুশন’ নামে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক দলে যোগ দেন।

ফেব্রুয়ারি মাসে, তরুণ ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় ফিউচার ফরোয়ার্ড নামে একটি রাজনৈতিক দলকে ভেঙে দেবার পর যে আকস্মিক প্রথম গণতন্ত্রপন্থী প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছিল, তার আয়োজনে তিনি সাহায্য করেন। দলটি তাদের নেতার কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ ঋণ নিয়েছিল এই রায়ের পর দলটি ভেঙে দেয়া হয়। তবে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে থাইল্যান্ডে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে গণতন্ত্রকামী আন্দোলন গতি পাচ্ছে তাতে তরুণ সম্প্রদায়ের যোগদানকে শুধু ওই পদক্ষেপই উৎসাহিত করেনি, আন্দোলন এই পর্যায়ে চলে আসার কারণও তারা।

অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মত পানুসায়াও বাসাতে অশান্তির মধ্যে রয়েছেন। কারণ তার বিরুদ্ধে ‘মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার’ অভিযোগ রয়েছে ঘরেও। তার সিদ্ধান্তে পানুসায়ার মা আতঙ্কিত। তিনি তাকে সমাবেশে যোগ না দেবার জন্য অনুরোধ করেছেন। এর পর পাঁচদিন মা-মেয়ে কথা বলেননি। পানুসায়া বলেন, ‘অবশ্যই আমার মা উদ্বিগ্ন। কিন্তু সেটা তিনি প্রকাশ করেন না এবং আমি যখন ধারে কাছে থাকি তিনি দেখান কিছু হয়নি, সব স্বাভাবিক আছে।

কিন্তু আমার বড় বোনের কাছে থাকলে তিনি কাঁদেন। আমার মাকে বুঝতে হবে আমরা মজা করার জন্য এসব করছি না। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমাদের এটা করতেই হবে। আমরা এটাকে আমাদের কর্তব্য বলে মনে করছি, মাকে সেটা বুঝতে হবে। আমি চাই তিনি আমার জন্য গর্ব বোধ করবেন।’ সূত্র: বিবিসি