ফলের দামে ছুটছে ঘাম

67
ফলের দামে ছুটছে ঘাম

দেশে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন বেশি করে ডাব, মাল্টা, কমলা এবং বেদানার মতো কিছু রসালো ফল খেতে। এতে করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী বিশেষ উপকার পাবেন। যদিও এসব ফল খেতেই হবে তেমনটিও বলছেন না চিকিৎসকরা। তবু মানুষ এসব ফল এখন বেশি বেশি কিনে খায়। এতে ফলের চাহিদা বেড়েছে বেশখানিকটা। ডাব নিয়ে এবার দেশে হুলুস্থুল কারবার হয়েছে। একটি ডাবের দাম ২৫০ টাকা পর্যন্তও উঠেছিল।

ডাবের মতোই মাল্টা, আপেল, কমলা, বেদানা এবং আঙুরের দামও অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবার। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এসব ফলের ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফা লুটে নিতে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের পকেট খালি করেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের ব্যবসায়ীদের মতো ফল ব্যবসায়ীরাও মুনাফার দুষ্টচক্রে যুক্ত হয়ে লুটপাট করছে।

Pop Ads

চট্টগ্রাম কাস্টমসের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশি ফল যে দামে আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা ভোক্তার হাতে তা পৌঁছায় তিনগুণেরও বেশি দামে। আমদানিকৃত ফলের মধ্যে এখন মাল্টার চাহিদা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ জন্য এই ফলে ব্যবসায়ীরা মুনাফাও করছে বেশি। কাস্টমস তথ্য বলছে সব ধরনের শুল্ক পরিশোধ করার পর বন্দরে প্রতি কেজি মাল্টার আমদানি মূল্য পড়ে ৯৮ টাকা ৮৮ পয়সা। অথচ এই মাল্টার কেজি সপ্তাহখানেক আগেও ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা হয়েছে। এ সপ্তাহে মাল্টার দাম কিছুটা কমে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। তবু এটি আমদানি মূল্যের তিনগুণ দাম।

চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে আরও জানা যায়, প্রতি কেজি কমলার আমদানি মূল্য পড়ে ১৬৬ টাকা ৩৬ পয়সা। অথচ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কমলা বিক্রি হয় ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকায়। প্রতি কেজি বেদানার আমদানি মূল্য পড়ে ২২০ টাকা ৭৫ পয়সা। অথচ খুচরাতে প্রতি কেজি বেদানা বিক্রি হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। প্রতি কেজি আঙুরের আমদানি মূল্য পড়ে ২২৪ টাকা ৮৮ পয়সা। খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি কেজি আপেলের আমদানি মূল্য পড়ে ১৪৫ টাকা ৬৫ পয়সা। অথচ খুচরা বাজারে বিক্রি হয় প্রতি কেজি আপেল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়।

এসব তথ্য জানিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার ব্যারিস্টার মো. বদরুজ্জামান মুন্সি রোববার সময়ের আলোকে বলেন, বিলাসী পণ্য হওয়ায় আপেল, কমলা-মাল্টার মতো বিদেশি ফল আমদানি নিরুৎসাহী করা হচ্ছে এখন। কারণ ডলার সংকট। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এসব বিদেশি ফল আমদানি কিন্তু থেমে নেই। প্রতিদিনই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশি ফল আমদানি করা হয়। সব ধরনের শুল্ক আদায়ের পরও এসব ফলের যে আমদানি মূল্য পড়ে, বাজারে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনতে হয় ভোক্তাকে। অথচ এসব ফল ভোক্তার হাতে আরও কম দামে যাওয়ার কথা।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে সব ধরনের ভোগ্য পণ্যের ব্যবসায়ীরাই অরাজকতা সৃষ্টি করছে। ব্যবসার নামে তারা লুট করছে দেশের মানুষের টাকা। ব্যবসায়ীদের যে বাড়তি মুনাফার দুষ্টচক্র চলছে দেশে, সে চক্র থেকে বাদ যায়নি ফল ব্যবসায়ীরাও। তাদের ভেতরেও অতি মুনাফার লোভ পেয়ে বসেছে। এতে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর ব্যবসায়ীদের এই লুটপাটের মনোভাবের কারণে দেশের মানুষের কষ্টের সীমা নেই। মানুষ এখন সব কষ্ট নীরবে সহ্য করে।

দুই বছরের ব্যবধানে ফলে দাম দ্বিগুণ
মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এসব ফলের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২১ সালে লাল রঙের আপেলের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা, বর্তমানে তা ৩৫০ টাকার বেশি। ২০০ টাকার সবুজ আপেলও এখন ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। মাল্টা ২০২১ সালে ছিল ১৫০ টাকা, কিন্তু বর্তমানে তা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে বিক্রি হয় ৩০০ টাকায়। ১২০ টাকার কমলা ৩ গুণ বেড়ে বিক্রি হয় ৩৫০ টাকায়। আঙুর ২০২১ সালে ২২০ টাকায় বিক্রি করা হলেও বর্তমানে ৪৫০ টাকা। একইভাবে ২৫০ টাকার বেদানা এখন হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। একই হারে অন্যান্য ফলেও দামও বেড়েছে।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ফল খাওয়া উচিত ২০০ গ্রাম

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর প্রতিবেদন তথ্য মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ফল খাওয়া উচিত ২০০ গ্রাম। বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে একজন মানুষের রোজ ফল খাওয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৫.৮০ গ্রাম। বর্তমানে দেশের মানুষের ফলমূল খাওয়া ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০০ গ্রাম। চাহিদা বাড়ায় দেশি ফলের উৎপাদনও বেড়েছে। দেশে ২০০৮-০৯ সালে ফলের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি টন, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ টনে, বিগত ১২ বছরে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ২২ শতাংশ।

বাড়ানো হয়েছে আমদানি শুল্ক
খাদ্যপণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিদেশি ফলকে ২০১২ সালে বিলাসী পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, আপেল, কমলা ও নাশপাতিকে বিলাসী পণ্যের তালিকায় রাখা হয়। এর প্রভাবে আগে যেখানে বিদেশি ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩ শতাংশ, সেটি গত ৯ মাস ধরে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। তার সঙ্গে আমদানিতে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৪ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাটও দিতে হয়।

বছরে ৮ লাখ টন ফল আমদানি
প্রতি বছর দেশে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টন ফল আমদানি করতে ১০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। ডলারের এই আকালের দিনে বিদেশি মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাওয়া ঠেকাতে সরকার অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি সব ধরনের ফল আমদানিকেও নিরুৎসাহী করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে দেশের বাজারে এখন বিদেশি ফলের প্রাপ্যতা গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে।

যেসব দেশ থেকে ফল আমদানি করা হয়
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে দুই ধরনের ফল আমদানি করা হয়-তাজা ফল বা ফ্রেশ ফ্রুটস ও শুষ্ক ফল বা ড্রাই ফ্রুটস। ফ্রেশ ফ্রুট ক্যাটাগরিতে আছে আপেল, কমলা, মাল্টা, ম্যান্ডারিন, আনার বা বেদানা, আঙুর, নাশপাতি, ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরি এবং কিউইসহ ৫২ রকমের ফল। ড্রাই ফ্রুটস ক্যাটাগরিতে আমদানি করা হয় খেজুর, কিশমিশ, আলুবোখরা এবং বিভিন্ন ধরনের বাদাম। এসব ফল আমদানি করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ভুটান, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, তিউনিশিয়া, পোল্যান্ড এবং ব্রাজিল থেকে। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ফল আসে ভারত থেকে।

যা বলছেন ফল ব্যবায়ীরা
ফলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য নিজেদের কোনো দায় নেই বলে জানিয়েছেন ফল ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, বিশ^বাজারে দাম বৃদ্ধি, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি এবং ডলারের দাম বৃদ্ধি-এই তিন কারণে বেড়েছে দেশের বাজারে ফলের দাম। এ প্রসঙ্গে ফল আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকার বিদেশি ফলের বেশ কয়েকটিকে বিলাসী পণ্য হিসাবে উল্লেখ করেছে। ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খুলতে চায় না ব্যাংকগুলো। এর পাশাপাশি বিদেশি ফলে সব ধরনের শুল্ক বাড়িয়েছে এনবিআর। এ কারণে আগের চেয়ে অন্তত অর্ধেক আমদানি কমেছে। সেই সঙ্গে ফলের দামও বেড়েছে। ফলে কম আমদানি হলেও সেগুলো বিক্রি করতে কষ্ট হয়। আমরা যে দামে ফল আমদানি করি তা থেকে খুবই অল্প লাভ রেখে বিক্রি করে দিই। খুচরা বাজারে গিয়ে দাম অনেক বেড়ে যায়। এটা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের।

ভোক্তার পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে
সব ধরনের ভোগ্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। এর মধ্যে ফলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পিঠ আরও দেয়ালে ঠেকে গেছে বলে জানালেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ফল কিনতে আসা শফিকুল ইসলাম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এই মাঝ বয়সি ক্রেতা গতকাল সময়ের আলোকে বলেন, ভাই, আমাদের কথা কে ভাবে। না ভাবে সরকার, না ভাবে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা যে একের পর এক পণ্যের দাম বাড়িয়ে লুটে নিচ্ছে আমাদের কষ্টের অর্থ। অথচ যেন দেখার কেউ নেই। আমার পরিবারের ৩ সদস্যের জ্বর। তাই ফল কিনতে এসেছি। কিন্তু যে দাম, কী ফল কিনব। ১০ টাকা দাম কমানোর জন্য ৫ দোকান ঘুরেছি। তার পর ১ কেজি মাল্টা কিনলাম। আমরা এখন মুখ বুজে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কষ্ট সহ্য করছি।