সফটওয়্যারে ভালো করলেও হার্ডওয়্যারে বাংলাদেশ পিছিয়ে কেন

10
সফটওয়্যারে ভালো করলেও হার্ডওয়্যারে বাংলাদেশ পিছিয়ে কেন

সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকলেও হার্ডওয়্যারে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। যেখানে বাংলাদেশ নিজে সফটওয়্যার বানিয়ে বাইরের ৬০ দেশে রফতানি করে, সেখানে হার্ডওয়্যারে দেশটির অবস্থান এক রকম তলানিতে বলা চলে।
গ্লোবাল লোকেশন সার্ভিস ইনডেক্সের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আইটির আউটসোর্সিং খাতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ২১তম। এছাড়া আউটসোর্সিং ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে।

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাব অনুযায়ী, দেশের জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ আসে আইটি খাত থেকে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৫ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে আইটি খাতের ওপর ভিত্তি করে।

Pop Ads

এ খাতের বাজার দেশে এবং দেশের বাইরে বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ দেশের বাইরে আউটসোর্সিং-এর কাজ করে গত অর্থবছরে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিগত কয়েক অর্থবছরে আইটি সেবা রফতানি করে ৫০০-৬০০ মিলিয়িন ডলার আয় করেছে।

আইটি খাতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের আইটি খাতে ৩০ লাখ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এ খাত থেকে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার।

বাজারএ খাতে বাংলাদেশের এ রমরমা অবস্থা মূলত সফটওয়্যারভিত্তিক। এখানে হার্ডওয়্যার খাতের অবদান একেবারেই অপ্রতুল।

হার্ডওয়্যার খাতে দেশ কেন পিছিয়ে আছে – এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স প্রকৌশল বিভাগের প্রধান সেজুতি রহমান সময় সংবাদকে বলেন,

চীন বা জার্মানির মতো দেশ যেখানে হার্ডওয়্যারের একটি কালচার গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, আমরা শুরু থেকেই সেখানে পিছিয়ে ছিলাম। বিশেষ করে বাজারে প্রবেশের জন্য যে মনোভাব দরকার বাংলাদেশের সেটি নেই।

সেজুতির মতে, ‘যেসব দেশ হার্ডওয়্যারে ভালো করছে, তারা শুরু থেকেই ইলেকট্রনিক্স বা মেকানিক্যাল পণ্য নিয়ে কাজ করে আসছে। আমাদের আইটি খাত বলতে গেলে পুরোটাই সফটওয়্যারকেন্দ্রিক। তাই এখানে হার্ডওয়্যারের কাজের পরিবেশ এবং পরিস্থিতি গড়ে উঠেনি।’

বর্তমানে বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার তৈরির প্রধান চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশলের (ইইই) প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান সময় সংবাদকে বলেন,

হার্ডওয়্যার তৈরি করতে গেলে হয় বাংলাদেশকে নিজের চিপ তৈরি করে পরে সেটি থেকে মাদারবোর্ড তৈরি করতে হবে, আর না হলে বাইরে থেকে চিপ আমদানি করে মাদারবোর্ড তৈরি করতে হবে।

বিশ্বের যেসব দেশ এখন কম খরচে হার্ডওয়্যার রফতানি করছে, সেটি একদিনে সম্ভব হয়নি। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যদিয়ে তারা খরচ কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশ এখন হার্ডওয়্যার তৈরি করে বিক্রি করতে চাইলে এর খরচ হবে অনেক। অনেকে বাড়তি দামে হার্ডওয়্যার কিনতে চাইবে না। আবার বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার তৈরির পূর্ব অভিজ্ঞতা বা কোনো অর্জন না থাকায় মার্কেটিংয়ে চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হবে। মেইড ইন বাংলাদেশ নামে পোশাকখাত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ঠিকই; কিন্তু একই ট্যাগ ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক্স খাতে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে বলে জানান হাবিব।

হার্ডওয়্যার খাতে চিপ তৈরি প্রসঙ্গে হাবিব বলেন,
বাংলাদেশ এখন মাইক্রোচিপ তৈরি করতে গেলে পুরো প্রযুক্তি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করে আনতে হবে। যেসব দেশ তিন ন্যানোমিটারের ট্রানজিস্টর আবিষ্কার করেছে, তারা চাইবে না এমন প্রযুক্তি অন্যদের হাতে যাক। এতে করে বাজারে প্রবেশ করতে বড় রকমের হিমশিম খাবে বাংলাদেশ।

সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (এসআইএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ৫৭৪.১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের চিপ বেচাকেনা হয়েছে, ২০২১ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫৫৫.৯ বিলিয়ন ডলার।

হার্ডওয়্যার খাতে বাংলাদেশের অন্যভাবে বড় রকমের সম্ভাবনা আছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ন্যানোমেটারিয়ালস অ্যান্ড সিরামিক প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এ এস এম এ হাসিব বলেন,
বাংলাদেশকে চিপ তৈরি করতে হবে এমন না, চিপ প্যাকেজিং-এর জন্য বাংলাদেশ নিজেদের এখন থেকে প্রস্তুত করতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলো চিপ প্যাকেজিং-এর জন্য সস্তা মানবসম্পদ খুঁজছে। সেক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশের জন্য ভালো একটি সুযোগ।

হার্ডওয়্যার খাতে দেশে মানবসম্পদের ব্যবহার নিয়ে প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলেন, দেশের পোশাক শিল্প মূলত শ্রমনির্ভর একটি খাত। অন্যদিকে হার্ডওয়্যার খাত দক্ষতানির্ভর। এ দুটি বাংলাদেশের রফতানি আয়ের হাল ধরতে অনন্য মাধ্যম হলেও, হার্ডওয়্যার খাত নিয়ে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক পথনকশা প্রস্তুত করতে হবে।