এক ‘স্মার্ট’ মায়ের গল্প

6
এক ‘স্মার্ট’ মায়ের গল্প

সত্য ঘটনা অবলম্বনে একটি গল্প বলি। কয়েক বছর আগের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসে এক সকালে এলেন মধ্যবয়সি প্রবাসী দম্পতি। আরবদের মতো পোশাক স্বামীর, আপাদমস্তক আচ্ছাদিত স্ত্রীরও তাই। চট্টগ্রামের কোনো এক জায়গায় স্ত্রীর পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত বাড়িসহ জমি আছে। স্বামীর পরামর্শে ভূমিসেবার কিছু কাজ করার জন্য স্ত্রী ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’, অর্থাত্ দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা অর্পণ করছেন দেশে বাস করা স্বামীর বন্ধুকে। ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র কাগজপত্র কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ইংরেজিতেই করে সবাই। প্রয়োজনীয় সত্যায়নের জন্য দূতাবাসে আসা বেশির ভাগ প্রবাসী এই ইংরেজিতে দাঁত বসাতে পারেন না। জায়গা দেখিয়ে দিলে কোনোমতে কাগজটায় স্বাক্ষর করেন, টিপসইও দেন অনেকে।

সত্যায়নের দায়িত্ব পালন করছিলেন এক নারী কর্মকর্তা। নিয়ম অনুযায়ী তার সামনেই যিনি দায়িত্ব প্রদান করছেন, তার স্বাক্ষর করতে হয়। এর আগে স্ত্রীর কাগজটি এনে স্বামী সত্যায়ন করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কর্মকর্তা রাজি হননি। সেজন্য বাধ্য হয়ে সেই সকালে স্ত্রীকে নিয়ে আসতে হয়েছিল অতিশয় ব্যস্ত স্বামীকে। সফল ব্যবসায়ী তিনি, প্রভাবশালীও বটে। কর্মকর্তা নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজি কাগজের পাঠোদ্ধার করে সেটার বাংলা করে বলছিলেন স্ত্রীকে। স্বামী বিরক্ত, কর্তৃত্বের স্বরে কর্মকর্তাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন সময় নষ্ট না করে সত্যায়িত করে দিতে। স্বামীর পাকা কথা, জমিসহ বাড়িটার খাজনা দেওয়া আর পরচা তোলার কাজ তার বন্ধুকে দিয়ে করাতে স্ত্রী খুশিমনেই সম্মতি দিয়েছেন। স্ত্রীও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। কিন্তু কর্মকর্তা দায়িত্বের পরিধি বাংলায় অনুবাদ করে পড়ে শোনানোর সময় বন্ধুকে ‘বিক্রির ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে জানালে স্ত্রী মুখের কাপড় একটানে খুলে স্বামীর মুখোমুখি হয়ে তীব্র স্বরে বললেন, ‘এ হথা তো তুই আরে ন ক!’ অর্থাত্ স্বামীর বন্ধুকে তার হয়ে বাড়ি বিক্রির ক্ষমতা তিনি দেননি। কর্মকর্তা এরপর সত্যায়নে রাজি হলেন না। কাগজপত্র ঠিক করে আনার পরামর্শ দিলেন। স্বামী বেজায় বিরক্ত হয়ে কর্মকর্তার সঙ্গেও খুব একটা শোভন ব্যবহার করতে পারলেন না। বেরিয়ে যেতে যেতে স্ত্রীর সঙ্গে যে আচরণ প্রদর্শন করলেন, তাতে বোঝা গেল স্বামীর ক্ষমতা বাড়ি গিয়ে প্রয়োগ করবেন তিনি।

Pop Ads

এরপর বেশ কয়েক দিন গেল। কাগজপত্র ঠিক করে না আনলেও স্বামী ভদ্রলোক নানান প্রভাবশালী পক্ষ দিয়ে কর্মকর্তাকে টেলিফোনে বোঝাতে চাইলেন, তার স্ত্রী ‘অশিক্ষিত’ নারী বলে সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারেননি, কাগজপত্র ঠিক আছে, কেননা ‘শিক্ষিত’ স্বামী খুব ভালোভাবে বোঝেন এবং কর্মকর্তা স্বামীর পরিচিতি ও প্রভাবকে আমলে নিয়ে চোখ বন্ধ করে সত্যায়ন করতে পারেন। কর্মকর্তা চোখ বন্ধ করতে রাজি হলেন না। তখন দূতাবাস-প্রধানের কাছে নালিশ গেল, তিনি অসহযোগিতা করছেন। সেই ঘোলা জলে ঢেউ লেগেছিল আরো, যখন স্বয়ং ভদ্রলোকের ‘শিক্ষিত’ বড় মেয়ে বাবা কর্তৃক বিগত সময়ে মায়ের ঠকে যাওয়ার আরো নানা তথ্য নিয়ে শেষ সম্বল বাড়িসহ জমি হাতছাড়া হওয়া ঠেকাতে দুর্দান্ত ভূমিকা রেখেছিলেন। বিস্তারিত বললে উপন্যাসিকা দাঁড়িয়ে যাবে নির্ঘাত।

কয়েক বছর পর, এই তো কদিন আগে সেই মেয়েটির মাধ্যমে সেই কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে গিয়ে সেই মা অঝোরে কাঁদলেন। তিনি এখনো প্রবাসী। আর প্রবাসে বসেই তিনি নিজের শেষ সম্বল সেই বাড়িসহ জমির দেখভাল করতে পারছেন, ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ দিতে হচ্ছে না। কী বিস্ময় তার কণ্ঠে! বলছেন, কীভাবে তিনি খাজনা পরিশোধ করলেন। আসলে, প্রবাসে বসেই মেয়ের সাহায্য নিয়ে কম্পিউটারের কয়েক ক্লিকের মাধ্যমে একটু আগেই খাজনা পরিশোধ করেছেন তিনি। জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই কাজটি করতে পেরেছেন তিনি এবং ভেবেছেন, এত সহজ সবকিছু! মেয়ে জানালেন মাকে, জন্মনিবন্ধন নম্বর দিয়েও সম্ভব সহজ করে তোলা কাজটি। তখন তিনি বিস্ময়কে আনন্দে পরিণত করতে মনে করলেন সেই বিষাদ দিনের কথা। মনে পড়ে গেল সেই কর্মকর্তার কথা। তিনি তার এই বিস্ময়মাখা আনন্দ সেই ‘আফা’র সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান। সত্যিই এ এক বিস্ময় সব প্রবাসীর কাছে। ভূমিসংক্রান্ত সব সেবা এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা সম্ভব। প্রবাসে বসেই ই-নামজারি, ই-মিউটেশন, ই-ল্যান্ড ট্যাক্স পরিশোধ করা সম্ভব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেসব অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তার সুফল এই ডিজিটাল ভূমিসেবা। এখন এটি পরিণত হচ্ছে ডিজিটাল ও স্মার্ট ভূমিসেবায়। এই ডিজিটাল ও স্মার্ট ভূমিসেবা নামক উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বেশ কিছু ডিজিটাল ও স্মার্ট উদ্যোগ। এই সব উদ্যোগ কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থাত্ ‘স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট সোসাইটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর ফলে কী ঘটছে ও ঘটতে যাচ্ছে, তা আন্দাজ করা প্রবাসী সেই মায়ের জন্য সম্ভব না হলেও তিনি কিন্তু ঠিক এরকমটিই চাইতেন মনে মনে। আমরা এই দেশের সব দেশি ও প্রবাসী নাগরিক মাত্রই তো চাই, সব ভূমি অফিস ক্যাশলেস হোক, তা-ই হচ্ছে। ভূমিসেবা উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। অর্থাত্ ভূমিসেবার জটিলতার কারণে এর আগে যেসব উদ্যোক্তাগণ আইডিয়া বাস্তবায়নে সাহস পাননি, তারা যেন খুব উত্সাহ নিয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন।

ডিজিটাল ভূমিসেবার সব উদ্যোগ যেহেতু সাইবার নিরাপত্তার বিশেষ দাবি রাখে, সেহেতু ডিজিটাল ও স্মার্ট ভূমিসেবার অন্যতম প্রধান উদ্যোগ হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তায় বিশেষায়িত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও ফার্মের এখন আর অভাব নেই। এর মধ্যেই ডিজিটাল ভূমিসেবার অ্যাপ চালু হয়ে গেছে এবং সব জনগণ যেন এই অ্যাপের মাধ্যমে ডিজিটাল ও স্মার্ট ভূমিসেবা গ্রহণ করতে উদ্যোগী হন, সে বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দপ্তর ও মাঠ পর্যায়ের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা গণসচেতনতা সৃষ্টির কাজটি করছেন, যা ক্রমশ আরো বেগবান হবে বলে আশা করা যায়।

কিউআর কোড স্ক্যান করেই, অর্থাত্ সম্পূর্ণ ডিজিটাল উপায়ে ভূমিসেবার অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন গ্রাহকরা। তাত্ক্ষণিকভাবে এই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা সরকারের আয় বাড়াবে এবং ভূমিসেবা সংক্রান্ত গ্রাহক হয়রানির পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ও অসাধু কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রতিহত করবে।

মধ্যপ্রাচ্যের সেই প্রবাসী নারী ডাকযোগে তার খতিয়ান পেয়ে গেছেন। তিনি তো এখন আর সব গ্রাহকের মতো ভূমিসেবা হটলাইন ১৬১২২ নম্বরে কথা বলে ভূমি পরামর্শ সেবা গ্রহণ করছেন। তার মেয়েটি টেলিফোন রাখার আগে হেসে জানালেন, মা এখন স্মার্ট হয়ে গেছেন! এতসব উন্নয়ন ভূমিসেবায় নারীর ক্ষমতায়নকে আরো সংহত করছে, নয় কি?