চন্দ্রশেখরের  কী?

9
চন্দ্রশেখরের  কী?

ছেলেটির বয়স তখন সবেমাত্র কুড়ি বছর। এই বয়সেই পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রী শেষ করেছে। ছাত্র হিসাবে সে খুবই ভালো। বাড়ি হলো মাদ্রাজে।

এখন যাকে সবাই চেন্নাই বলে চেনে। ছেলেটি একটি স্কলারশিপ পেয়েছে কেমব্রিজে পিএইচডি করার জন্য। তাঁর পছন্দের বিষয় হল জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান। এই বিষয় নিয়ে তাঁর রয়েছে প্রচন্ড আগ্রহ।

Pop Ads

তাঁর জন্ম হয়েছিলো এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। চাচা চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী। আলোক রশ্মি বিচ্ছুরণের উপর গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর আবিষ্কার ‘রামন এফেক্ট’ বিজ্ঞানীমহলে সুপরিচিত।

ভাতিজার নামও চন্দ্রশেখর। পুরো নাম সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর। চাচার মতই সে তুখোড় মেধাবী।
সময়টা ১৯৩০ সন। সে বছর চাচা পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

আর ভাতিজা পড়তে যাচ্ছে কেমব্রিজে। তখনকার যুগে ইংল্যান্ডে যেতে হতো জাহাজে করে। কুড়ি বছর বয়সী চন্দ্রশেখর মাদ্রাজ থেকে জাহাজে উঠলেন। অনেক দূরের পথ। প্রায় তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। চন্দ্রশেখর সময়টি অপচয় করলেন না। কাগজ কলম নিয়ে বসলেন একটি সমস্যার সমাধান করতে। সমস্যাটির বিষয়বস্তু ছিল নক্ষত্রের জীবন চক্র নিয়ে। এ নিয়ে চন্দ্রশেখর অনেকদিন ধরেই ভাবনা চিন্তা করছেন। এখন সময় পেয়েছেন এ নিয়ে ঠান্ডা মাথায় গবেষণা করার। এ বিষয়ে অনেক পড়াশোনা চন্দ্রশেখর ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন। তাঁর ইচ্ছে হলো এনিয়ে কেমব্রিজে গবেষণা করার।
তখন বিজ্ঞানী মহলে নক্ষত্রের জীবন চক্র নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা জানতে চান একটি নক্ষত্রের জন্ম এবং মৃত্যু হয় কীভাবে। এসব গবেষণার পুরোভাগে ছিলেন কেমব্রিজের একজন অধ্যাপক যার, নাম হলো স্যার আর্থার এডিংটন। সেই সময় স্যার এডিংটন ছিলেন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের একজন দিকপাল। তিনি মনে করতেন সকল নক্ষত্রের জন্ম এবং মৃত্যু একই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হয়। প্রক্রিয়াটা হলো এরকম: হাইড্রোজেন গ্যাস মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পুঞ্জিভূত হতে হতে নক্ষত্রের কেন্দ্রে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে থার্মো নিউক্লিয়ার ফিউশন (ঋঁংরড়হ) প্রক্রিয়া শুরু হয়। হাইড্রোজেন পরমাণু হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তির উদ্ভব হয় এবং নক্ষত্রটি তখন প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। এভাবেই একটি নক্ষত্রের জন্ম হয়। এরপর নক্ষত্রটি জ্বলতে থাকে দীর্ঘদিন। কিন্তু এক সময় নক্ষত্রের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে যেতে থাকে। হিলিয়াম পরমাণুও আস্তে আস্তে আরো ভারী পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়। ধীরে ধীরে নক্ষত্রের কেন্দ্রে আয়রনের মত ভারী পরমাণুর সৃষ্টি হয়। এই সময় নক্ষত্রটির আয়তন অনেক বৃদ্ধি পায়। এটি একটি বিশাল লোহিত দানব (জবফ এরধহঃ) নক্ষত্রে পরিণত হয়। নক্ষত্রটি তখনও প্রজ্জ্বলিত থাকে। কিন্তু এর উত্তাপ কমে যায়। তারপর আস্তে আস্তে নক্ষত্রটির হাইড্রোজেন জ্বালানি আরো ফুরিয়ে যায়। তখন সেটা সংকুচিত হতে হতে একটা শ্বেত বামন (ডযরঃব উধিৎভ) নক্ষত্রে পরিণত হয়। আর এভাবেই ধীরে ধীরে একটি নক্ষত্রের জীবনাবসান হয়।

তখনকার দিনে এটিই ছিল নক্ষত্রের জীবন চক্রের সর্বস্বীকৃত মডেল। স্যার আর্থার এডিংটন ছিলেন এর প্রবক্তা। কিন্তু তরুণ চন্দ্রশেখরের জিজ্ঞাসু মনে তখন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি জানতেন নক্ষত্রের ভিতরে ইলেকট্রনের চাপ (বষবপঃৎড়হ ফবমবহবৎধপু ঢ়ৎবংংঁৎব) এবং নক্ষত্রের নিজস্ব মহাকর্ষ বল (মৎধারঃধঃরড়হধষ ভড়ৎপব) এ দু’য়ের মাঝে একটি ভারসাম্য রয়েছে। এই ভারসাম্য থাকার ফলেই নক্ষত্রটি মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ধ্বংস (পড়ষষধঢ়ংব) হয়ে যায় না। কিন্তু তাঁর মনে হলো, এই ভারসাম্যটি নির্ভর করে নক্ষত্রটির ভরের উপর। তিনি তখন জাহাজে বসেই বেশকিছু জটিল সমীকরণ সমাধান করে নক্ষত্রের এই ভর সীমাটি নির্ণয় করলেন। তিনি অংক কষে বের করলেন, শ্বেত বামন নক্ষত্রের সর্বোচ্চ ভরসীমা হলো সৌর ভরের ১.৪৪ গুন । তার মানে হলো, কোন শ্বেত বামন নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের চাইতে ১.৪৪ গুন বা তার চেয়ে বেশি হয় তবে সেটি আর শ্বেত বামন নক্ষত্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না। নক্ষত্রটি তখন সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হবে।

কেমব্রিজে পৌঁছানোর পর তিনি এই নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন প্রফেসর ফাউলারের অধীনে। এনিয়ে ১৯৩১ সালে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করলেন। গবেষণা পত্রটি প্রকাশ হওয়ার পর তিনি প্রফেসর স্যার আর্থার এডিংটনের রোষানলে পড়লেন। এডিংটন ছিলেন খুবই প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তিনি কোনভাবেই তরুণ চন্দ্রশেখরের গবেষণার ফলাফল মেনে নিতে পারলেন না। চন্দ্রশেখরের গবেষণার প্রচন্ড সমালোচনা করতে থাকলেন। এতে চন্দ্রশেখর মনে খুব আঘাত পেলেও মুখে কিছুই বললেন না। তিনি মুখ বুজে তাঁর পিএইচডির কাজ শেষ করলেন। পিএইচডির পরও কয়েক বছর তিনি কেমব্রিজে ছিলেন। তারপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোতে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে। এরপর তিনি সারাজীবন আমেরিকাতেই ছিলেন।

আর্থার এডিংটনের চরম বিরোধিতার কারণে চন্দ্রশেখরের গবেষণার ফলাফল মেনে নিতে কেমব্রিজের বিজ্ঞানী মহল ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। সে জন্যই মূলত তিনি কেমব্রিজ ছেড়ে চলে যান। কিন্তু পরবর্তীতে অনেক পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে চন্দ্রশেখরই সঠিক ছিলেন।এডিংটন ছিলেন ভুল।
তাঁর আবিষ্কার এখন সারা পৃথিবীতে “চন্দ্রশেখর সীমা” (ঈযধহফৎধংবশযধৎ ষরসরঃ) হিসেবে পরিচিত। যে সব শ্বেত বামন নক্ষত্রের ভর চন্দ্রশেখর সীমার চেয়ে বেশি তাদের অকাল মৃত্যু হয় প্রচন্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে। আর এই বিস্ফোরণের ফলে নক্ষত্রটি একটি ব্ল্যাকহোল অথবা নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হতে পারে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য চন্দ্রশেখরকে ১৯৮৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু এই পুরস্কারটির জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অর্ধ শতাব্দীর চেয়েও বেশি সময়। পুরস্কারের চেয়েও বড় কথা হলো তাঁর আবিষ্কারটি এখন একটি সার্বজনীন বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। অনেকের ধারণা এডিংটন তখন বিরোধিতা না করলে এই স্বীকৃতিটি তাঁর অনেক আগেই প্রাপ্য ছিল। বিজ্ঞানী হিসেবে চন্দ্রশেখর তাঁর সীমা অতিক্রম না করলেও, দুঃখজনকভাবে স্যার আর্থার এডিংটন সেটা করেছিলেন।

১৯৯৫ সালে সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর ৮৫ বছর বয়সে লোকান্তরিত হয়েছেন। ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নাসা মহাকাশে তাদের স্থাপিত উচ্চ প্রযুক্তির এক্সরে অবজারভেটরির নাম দিয়েছে ঈযধহফৎধ ঢ-ৎধু ঙনংবৎাধঃড়ৎু (ঈঢঙ)। এর কাজ হলো মহাকাশে ব্ল্যাকহোল, কোয়াসার, সুপারনোভা ইত্যাদি বিভিন্ন উচ্চশক্তির এক্সরে উৎসের সন্ধান করা।

এখানে বলে রাখি, একই পরিবারে চাচা এবং ভাতিজা দুইজনই নোবেল বিজয়ী। তাও আবার পদার্থবিজ্ঞানের মতন বিষয়ে। এটি একটি বিরল ঘটনা।