চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা দায়ী

6
চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা দায়ী

চালের বাজার কৃষক বা সরকারের হাতে পরিচালিত হচ্ছে না। বাজারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। সরকারের এই ব্যবস্থাপনা সমস্যার কারণেই এবার আমনের ভরা মৌসুমেও বাজারে চালের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজীব আহমেদ

ড. জাহাঙ্গীর আলম খান : চালের বর্তমান দর যেটা রয়েছে, সেটা অস্বাভাবিক।

Pop Ads

আমনের ভরা মৌসুমে চালের এত বেশি দাম কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়, যুক্তিসংগত নয়। এবার আমনের উৎপাদন বেশ ভালো হয়েছে। বাজারেও পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে।
সরকারের চালসহ খাদ্যশস্য মজুদও সন্তোষজনক রয়েছে।

মূলত সরকারের ব্যবস্থাপনা সমস্যার কারণেই বাজারে চালের দাম বাড়তি। বর্তমানে চালের বাজার কৃষক বা সরকারের হাতে পরিচালনা হচ্ছে না, চালের বাজার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। তাঁরাই অসাধু পন্থায় অতি মুনাফার লোভে চালের দাম বাড়িয়েছেন।তাতে কষ্ট পাচ্ছে গরিব খেটে খাওয়া মানুষ।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন এবং সরকারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্রমাগত অভিযান পরিচালনা করার কারণে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজির মূল্য দু-তিন টাকা শিথিল হলেও খুচরা পর্যায়ে তার কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

ড. জাহাঙ্গীর আলম খান : বর্তমানে দেশে চালের কোনো সংকট নেই।

সরকারি পর্যায়ে চালের মজুদ আছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন। গমসহ মোট খাদ্যশস্য আছে প্রায় ১৭ লাখ টন।

আমন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ টন। ধান সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ টন অর্জন করতে পারবে।
কিন্তু ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না। এর আগেও কখনো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ ধান তোলার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকরা ধান বিক্রি করে দিয়েছেন চাতালের মালিক ও বড় করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিদের কাছে। ৩০ টাকা কেজি দরে শুকনা ধান সরকারি গুদামে গিয়ে দিয়ে আসার মতো সুযোগ তাঁদের আর তেমন নেই। এখন বাজারজাত উদ্বৃত্ত ধান সবই বড় ব্যবসায়ী ও চাতালের মালিকদের হাতে কুক্ষিগত। তাঁরাই সরকারকে চাল সরবরাহ করছেন। তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার। মূল্য নির্ধারণ করছেন তাঁরাই। মূল্যবৃদ্ধির কারসাজিও করছেন তাঁরাই।

এবার দেশে আমনের উৎপাদন ভালো হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পরপর ঘূর্ণিঝড় ও টানা বৃষ্টির কারণে আমন ধানের কিছুটা ক্ষতি হলেও দেশের উত্তরাঞ্চলে ও মধ্যাঞ্চলে বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে এই মৌসুমে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ৭০ লাখ টন অর্জন করা সম্ভব না হলেও কমপক্ষে দেড় কোটি টন হবেই। এটা আমাদের বার্ষিক খোরাকির অর্ধেক। আগামী এপ্রিল মাস পর্যন্ত অর্থাৎ বোরো ধানের মৌসুম পর্যন্ত তাতে অনায়াসেই চলবে। অতএব, দেশে চালের কোনো সরবরাহ সংকট নেই। এর দুর্মূল্য ব্যবসায়ীদের সৃষ্ট। তাঁদের লাগাম টেনে ধরতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু সুফল মিলছে না। কারণ রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের অনৈতিক জোট ভাঙা যাচ্ছে না।

ড. জাহাঙ্গীর আলম খান : গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এ দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। এখন তা নেমে এসেছে সাড়ে ৯ শতাংশে। পর্যাপ্ত উৎপাদন না হওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রামান হ্রাস, বিদেশি মুদ্রা সংকটের কারণে অপ্রতুল আমদানি, অতিরিক্ত শুল্ক হার এবং বৈশ্বিক উচ্চ মূল্য আমাদের দেশে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বৃত্তায়ন। শুধু চালের ক্ষেত্রেই নয়, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্য তেল ও চিনির ক্ষেত্রেও এই দুর্বৃত্তায়নের সন্ধান আমরা পেয়েছি। এতে কলকাঠি নাড়ছেন আমাদের ব্যবসায়ীরা। এখনই তাঁদের লাগাম টেনে ধরা দরকার। বর্তমানে নতুন সরকার ক্ষমতায় বসেছে। অপ্রীতিকর শক্ত অবস্থানে থেকে জনস্বার্থের কাজগুলো করে নেওয়ার এখনই সময়।

ড. জাহাঙ্গীর আলম খান : চালের মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখার প্রধান উপায় ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি। সামনে বোরো ধানের মৌসুম। এ দেশে ৫৪ শতাংশ চাল সরবরাহ হয় বোরো ধানের উৎপাদন থেকে। সাম্প্রতিক দীর্ঘ শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে বোরোর চারা উৎপাদন ও রোপণের কাজ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। তথাপি বোরো মৌসুম মোটামুটি নিরাপদ। তবে এ ধান সেচনির্ভর। রাসায়নিক সারের প্রতি সংবেদনশীল। এ দুটি উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাসের সংকটে যেহেতু চট্টগ্রামের সার কারখানাগুলোর উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে, সেখানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা দরকার। জ্বালানি তেলের দাম এখনো বেশি। পানি সেচের প্রায় ৬৫ শতাংশ নির্ভরতা জ্বালানি তেলের ওপর। এখানে ভর্তুকি দেওয়া দরকার। এখানে আচ্ছাদিত ভর্তুকি সম্ভব নয় বিধায় কৃষকদের নগদ সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এতে ধানের উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব হবে।

ড. জাহাঙ্গীর আলম খান : চালের উচ্চ মূল্য ঠেকাতে আমদানি করা উচিত। চলতি অর্থবছরে এ নাগাদ পণ্যটি আমদানি করা হয়নি। গত অর্থবছরে চাল আমদানি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন। এর আগের অর্থবছরেও ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছিল। এবারও আমদানি করা প্রয়োজন হতে পারে ১০ লাখ টন। অভ্যন্তরীণ মজুদ বৃদ্ধির জন্য তা খুবই দরকার। কমপক্ষে ২৫ লাখ টন মজুদ গড়ে তুলতে না পারলে চালের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হয়ে পড়বে। তা ছাড়া খোলাবাজারে হস্তক্ষেপ ও গরিববান্ধব চাল বিতরণ কর্মসূচি সম্প্রসারণের জন্য মজুদের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে চাল সংগ্রহ বাড়ানো হলে এর বাজার আরো চড়ে যেতে পারে। অতএব, আমদানি করা নিরাপদ।