ভারত -চীন কি তাহলে যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে ?

সুপ্রভাত বগুড়া (আন্তর্জাতিক): চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্তবিরোধ নতুন নয়। এর আগেও এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে শেষ এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। সেবার চার ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিল অরুণাচল প্রদেশে। আর ১৯৬২ সালে ছোটখাটো একটি যুদ্ধ হয়েছিল এ দুই দেশের মধ্যে।

ফলে এবারের সীমান্তে হতাহতের ঘটনায় শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, অর্থনৈতিক, ভূখ-গত ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের খেলায় চরম শত্রুভাবাপন্ন দুই রাষ্ট্র সত্যি সত্যিই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না তো? গোটা দুনিয়ার মানুষ যখন মরণব্যাধি করোনা থেকে বাঁচতে প্রাণপণ লড়াই করছে, তখন চীন-ভারত সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। বিশ্বের মানচিত্রে শক্তিধর দুই রাষ্ট্র আবার সীমান্তে মুখোমুখি।

Pop Ads

প্রায় ৪৫ বছর পর ১৫ জুন রাতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের লাদাখ এলাকার সীমান্তে দুই দেশের জওয়ানদের তুমুল সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ২০ জন ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান। চীনেরও বেশ কিছু জওয়ান এ সংঘর্ষে হতাহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। যদিও এর সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি।

তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দুপক্ষের সেনাদের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ হলেও গুলি চলেনি। ঘুষাঘুষি, পাথর ছোড়াছুড়ি হয়! ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধের পর দুই দেশের সীমান্তের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) ঠিক হয়। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে এ নিয়ে কোনো সম্মতি ছিল না, ছিল না কোনো নিয়ন্ত্রণ। তবে দুপক্ষ সম্মত হয়েছিল যে, তারা সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া টহল দেবে।

কিন্তু সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এমন সংঘর্ষের ঘটনা আরও ঘটতে পারে। চীন ও ভারত-দুটি দেশই বছর দশেক ধরে তাদের সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। চীন এটা করেছে তিব্বতে। আর ভারত করেছে দক্ষিণের অরুণাচল প্রদেশে ও লাদাখ অঞ্চলে। দুটি দেশই এসব জায়গায় রাস্তাঘাট করেছে, বিমান ঘাঁটি বানিয়েছে। রাডার স্টেশন বসিয়েছে। সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি করেছে।

দুপক্ষই বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ-সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে। সেখানে সামরিক মহড়াও দিয়েছে দুই দেশ। কাজেই একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব সাম্প্রতিক মাসগুলোয় দেখা যাচ্ছে। এবারের সমস্যার শুরুটা একটি রাস্তা তৈরি নিয়ে। লাদাখের লেহ থেকে দারবুক, শাইয়োক হয়ে দৌলত বেগ ওলডি বিমান ঘাঁটি পর্যন্ত ‘অল ওয়েদার রোড’ নামে একটি সড়ক তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে ভারত। গালওয়ান ভ্যালি হয়ে এ রাস্তা কারাকোরাম পাসের সিয়াচেন পর্যন্ত গিয়েছে।

এ রাস্তা নিয়েই আপত্তি চীনের। কারণ কারাকোরাম পাস হলো এমন একটি দুর্গম এলাকা, যেখানে খুব কাছাকাছি চীন, পাকিস্তান ও ভারতীয় সেনা টহল দেয়। একবার ভারী সামরিক যান চালানো শুরু করলে গোটা এলাকার কৌশলগত সুবিধা চলে আসবে ভারতের হাতে। চাপে পড়বে চীন ও পাকিস্তান। এ সুযোগ ভারত যাতে না নিতে পারে, সে জন্যই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর রাস্তা তৈরির বিরোধিতা করছে চীন। ১৫ জুন রাতে ২০ জওয়ানের প্রাণহানিতে ক্ষুব্ধ ভারত চীনের বিরুদ্ধে ফুঁঁসে উঠেছে। নতুন করে আবার চীনা পণ্য বয়কটের ডাক আসছে।

ভারতীয় ব্যবসায়ীদের এক সংগঠন বলেছে, তিন হাজারেরও অধিক পণ্যের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলো চীন থেকে তৈরি হয়ে ভারতের বাজারে আসে। এ তালিকায় রয়েছে টেক্সটাইল, বিল্ডার হার্ডওয়্যার, ফুটওয়্যার, গার্মেন্টস, রান্নাঘরের জিনিস, লাগেজ, হ্যান্ড ব্যাগ, কসমেটিকস, গিফট, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস জিনিসপত্র ইত্যাদি। বর্তমানে চীন থেকে ভারতে প্রতিবছর ৫ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়। ভারতে সস্তা জিনিসের বাজারের কথা মাথায় রেখে এ পণ্য বিক্রি করা হয়।

২০২১ সালের মধ্যে চীন থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার পণ্য আমদানি কমিয়ে ফেলার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সংগঠনটি। ভারতীয় সরকার অবকাঠামো নির্মাণে চীনা সংস্থাগুলোকে দেওয়া কার্যাদেশও বাতিল করতে পারে বলে আলোচনা শোনা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, দিল্লি-মিরাট আরআরটিএস (রিজিওনাল র‌্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম) প্রকল্প। এ প্রজেক্টের আওতায় নিউ অশোকনগর থেকে সাহিবাবাদ পর্যন্ত প্রায় ৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড রাস্তা তৈরি হওয়ার কথা।

এ ছাড়া টেলিকমব্যবস্থা ফোরজিতে আপগ্রেডেশনের জন্য চীন থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি না করার কথাও ভাবা হচ্ছে। মজার ব্যপার হলো, চীন তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে না পারলেও ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ও প্রভাব উত্তরোত্তর মজবুত করেছে। ভারতের সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের কারণে পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশের সমর্থনের পাল্লা চীনের দিকেই ভারী।

ওদিকে চরম আধিপত্যবাদী মনোভাবের কারণে চীনের ওপরও তার প্রতিবেশী দেশগুলো মোটেও প্রসন্ন নয়। জাপান, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো। আর চীনকে জব্দ করার যে কোনো লড়াইয়ে আমেরিকা সবার আগে হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই বিচেনাতেই ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সুসম্পর্ক।

সামরিক দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও সমর্থনের বিচারে ভারতের চেয়ে চীন পিছিয়ে। আবার নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ায় জাতিসংঘেও চীনের বাড়তি সুবিধা আছে, যেটা ভারতের নেই। চীন এখন এক নম্বর বিশ্বশক্তিতে পরিণত হতে চায়। তার টার্গেট আমেরিকা। আমেরিকাকে পেছনে ফেলে তার জায়গা নিতে চায় চীন। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে চীন বলীয়ান।

এদিকে ভারতও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চায়। গত কয়েক দশকে চীনের সঙ্গে তার শক্তিমত্তার ব্যবধান বেড়েছে। তবে চীন এখন ভারত থেকে শক্তির বিচারে অনেকটাই এগিয়ে। চীনের সামরিক ব্যয় বর্তমানে ভারতে সামরিক ব্যয়ের তিন গুণেরও বেশি। উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতিও ব্যাপক। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন কখনই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে না। কারণ যুদ্ধ শুরু করলে লড়াইটা শুধু ভারতের সঙ্গেই হবে না। এর সঙ্গে আরও নানা পক্ষ জড়িয়ে যাবে।

উভয় দেশই অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে জর্জরিত। ফলে উভয়েই শেষ পর্যন্ত শান্তি বজায় রাখতে আগ্রহী হবে। চীনের সামনে বর্তমানে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে হংকং, জিনজিয়াং ও করোনাপরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মতো বিষয়। ফলে আরেকটি যুদ্ধে জড়ানোর কোনো কারণ নেই চীনের দিক থেকে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ চীন-ভারতের বর্তমান বৈরিতাকে ‘পাতানো’ বলেও মনে করছেন। তাদের মতে, করোনা ভাইরাস মোকাবিলাসহ আগে-পরের নানা ধরনের ব্যর্থতা ঢাকতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের এমন একটি সীমান্ত উত্তেজনার এই মুহূর্তে ভীষণ রকম দরকার।

ঠিক একই রকমভাবে এ ধরনের মহামারী পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চীনও চায় নিজের অভীষ্ট অর্জন করতে। বিশেষত হংকংয়ে যে নিরাপত্তা আইন বেইজিং শেষ পর্যন্ত করিয়ে নিয়েছে, তা এমন পরিস্থিতি না থাকলে সম্ভব হতো না বলে মনে করা হচ্ছে। কাজেই সীমান্তে এ ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক। তবে চীন ও ভারতে ক্ষমতাসীন দুই উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকারের কারণে যে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে। দুই বছর আগেই ভারত-ভুটান-চীন সীমান্তে ডোকলামে অশান্তির পারদ বিপদসীমা ছাড়িয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরণ ঘটেনি।

এবার কয়েক সপ্তাহ ধরে লাদাখে মেঘ ঘনিয়েছে, বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কার বাণী উচ্চারিত হয়েছে, শোনা গিয়েছে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার পথে উত্তেজনা প্রশমনের পরামর্শও। কিন্তু চীন-ভারত কেউই সে পথে হাঁটেনি। বিধ্বস্ত অর্থনীতির শ্মশানে বসেও ভারত গোয়ার্তুমির পথে এগিয়েছে। আর চীনও করোনার কারণে সারাবিশ্বের কাছে নিন্দিত হয়েও আগ্রাসী ভূমিকা থেকে সরে আসেনি। ফলে লাদাখে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

এ ঘটনার পর ভারতজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ২০ জন নিহত জওয়ানের খুনের প্রতিশোধ নিতে দেশপ্রেমের ভাবাবগতাড়িত পুরো জাতি। ইতোমধ্যেই শানা যাচ্ছে উগ্র অতিজাতীয়তাবাদী নির্ঘোষ। শাসক দলের ভক্তরা এ ব্যাপারে যথারীতি তৎপর, এমনকি সেই দলের নেতৃত্বের কণ্ঠেও ‘সমুচিত জবাব’ দেওয়ার হুঙ্কার ধ্বনিত হচ্ছে।

যদিও যুদ্ধ করে এ যুগে কেউ জেতে না। জনবহুল ও পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দুই দেশ যুদ্ধে জড়ালে গোটা পৃথিবীই হেরে যাবে। তাই উত্তেজনার পারদ নামিয়ে এনে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, যুদ্ধের রণ-দামামার মধ্যেও ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চীনের তত্ত্বাবধানে থাকা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)।

করোনা-উত্তর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে ভারতের জন্য ৭৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ঘটনা। এ মুহূর্তে দরকার আত্মসংযম। যে সংযমের দায় উভয় দেশের সব রাজনৈতিক শিবিরের এবং অবশ্যই নাগরিক সমাজের।

গোটা দুনিয়ার মানুষ করোনার কারণে গভীর সংকটের কবলে। অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ভারত-চীনও এ বিপদ থেকে মুক্ত নয়। এ পরিস্থিতিতে যেন বাড়তি উদ্বেগের সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির প্ররোচনা এবং নির্বোধ অসংযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধটিই এখন বেশি জরুরি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here