নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন বিপত্তিতে ব্যাহত হতে পারে বাস্তবায়ন

4
নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন বিপত্তিতে ব্যাহত হতে পারে বাস্তবায়ন

ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিষয়টি অসম্পূর্ণ থাকায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ব্যাহত হতে পারে। নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যতম উপাদান শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক পরীক্ষার বদলে শিখনকালীন মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা ধারাবাহিকভাবে করতে হবে। এ পদ্ধতিতে মাস বা বছর ধরে নয়, শিক্ষার্থীদের দৈনিক শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করা সম্ভব।

তবে দেশজুড়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণিতে যে পদ্ধতিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন মহলে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তাদের ভাষ্য, অসম্পূর্ণ মূল্যায়ন ব্যবস্থার কারণে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন বাধার মুখে পড়তে পারে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আগের তুলনায় অবনমন হতে পারে শিক্ষাব্যবস্থার।

Pop Ads

শিক্ষাবিদরা বলছেন, নামমাত্র ধারাবাহিক মূল্যায়ন রাখা হলেও যে পদ্ধতিতে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা অসম্পূর্ণ ও অনুপযোগী।

ধারাবাহিক মূল্যায়নের অন্যতম উপাদান রেমিডিয়াল (ঘাটতি পূরণ) ক্লাস। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করার পাশাপাশি দুর্বলতা কাটাতে নিয়মিত রেমিডিয়াল ক্লাস নেওয়ার কথা। এসব ক্লাসের ব্যবস্থা না থাকলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়ায়ুল কবির দুলু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার জানা মতে, দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধারাবাহিক মূল্যায়ন শেষে নিয়মিত রেমিডিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা করে না।

এসব ক্লাস তদারকিতেও শিক্ষা অধিদপ্তরগুলোর আঞ্চলিক অফিস থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। রাজধানীর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি শ্রেণিকক্ষে ৭০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থী থাকে। একজন শিক্ষকের পক্ষে সব শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। যেখানে মূল্যায়নে ঘাটতি থাকছে, সেখানে রেমিডিয়াল ক্লাস কিভাবে হবে। তবে মানসম্মত পাঠদানের কারণে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের খুব বেশি সমস্যা হয় না।

অন্যদিকে দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র আরো ভয়াবহ।’
রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ-মতিঝিল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ধারাবাহিক মূল্যায়ন শেষে নিয়মিত রেমিডিয়াল ক্লাসের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। তবে বিশেষ প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি ক্লাসের আয়োজন করা হয়।

সারা দেশে বর্তমানে সাতটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠদান চলছে। ২০২৭ সাল পর্যন্ত দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে। চলতি বছর প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। এর আগের বছর প্রাথমিকের প্রথম ও মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে রেমিডিয়াল ক্লাসের প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমে গেছে। আবার সব বিষয়ে এসব ক্লাসের প্রয়োজন হয় না। এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে ব্যাবহারিক প্রক্রিয়ায় পড়াশোনা করছে। ক্লাসের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরাও বন্ধুদের সঙ্গে দলগত শিক্ষায় অংশ নেওয়ায় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছে। এখন থেকে ‘ব্যাক-বেঞ্চার’ বলতে কোনো শব্দ থাকবে না।

নেহাল আহমেদ বলেন, যেখানে দুর্বল শিক্ষার্থী আছে, সেখানে বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে তাঁরা এসব বিষয়ে নজরদারি করতে পারবেন। শিক্ষার্থী মূল্যায়নে নৈপুণ্য অ্যাপ ব্যবহারে শিক্ষকরা এখনো পারদর্শী হয়ে ওঠেননি। তবে ধীরে ধীরে তাঁরাও অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, রেমিডিয়াল ক্লাসের বিষয়ে মাউশি থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নির্দেশনা নেই। এ বিষয়ে শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন সম্পূর্ণ শিক্ষকদের এখতিয়ার। পছন্দের শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে মূল্যায়নের সুযোগ থাকছে। এমন ব্যবস্থাপনার কারণে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে শিক্ষার্থীরা। বাড়তে পারে কোচিং বাণিজ্য।

বর্তমানে মূল্যায়নব্যবস্থা একেবারে জগাখিচুড়ি করে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হালিম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন বলতে যা বোঝায়, বাস্তবে তা রাখা হয়নি। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে প্রতিটি ক্লাসে ২০ থেকে ৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী রাখা যাবে না। ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য রেমিডিয়াল ক্লাসের ব্যবস্থা না করতে পারলে তারা আরো পিছিয়ে পড়বে। দেশে প্রয়োগ উপযোগী শিক্ষাক্রম করতে না পারলে উন্নয়নের বদলে শিক্ষায় ধস নামবে। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে চাহিদার পরিবর্তন হয়। রাষ্ট্রের চাহিদার ভিত্তিতে সময়োপযোগী শিক্ষাক্রম তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা দেশের উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের মাধ্যমে যতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব, ততটুকুই পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

এর আগে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানান, ধারাবাহিক মূল্যায়নসহ ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আরো বেশি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশদভাবে পর্যালোচনা করতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের আহবান জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী জানান, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি, সেখানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের পরিবর্তে পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।