পিরামিড রহস্য ৫

2
পিরামিড রহস্য ৫

পাথর না হয় তোলা হলো। কিন্তু খনি থেকে পাথর তুলেই কি সেটা ব্যবহার করা যায়? একেক পাথরের তো একেক রকম আকার। বিল্ডিং ব্লক হিসেবে মোটেও নানা রকম, নানা আকারের পাথর নিলে চলে না। ইটের মতো একই আকারের একই চেহারার পাথর দরকার।

সেটা পেতে হলে কাটতে হয় পাথরকে। মিসরীয়রাও পাথর কাটত। কিন্তু সেটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল তাদের জন্য। খুফুর পিরামিড যখন তৈরি হচ্ছে, তখনো শুরু হয়নি লৌহযুগ।

Pop Ads

অর্থাৎ লোহার ব্যবহার শেখেনি মানুষ। তাই একালের মতো লোহার ছেনি বা হাতুড়ি ছিল না। একটা বিকল্প ছিল তাদের হাতে, সেটারই সদ্ব্যবহার করে তারা। তামার ব্যবহার জানত খুফুর আমলের লোকেরা।

একটা সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন শুধু তামা দিয়েই বুঝি ছেনি বা অন্যান্য ধারালো সরঞ্জাম তৈরি করা হতো। কিন্তু তামা লোহার মতো শক্ত-পোক্ত নয়। নমনীয়। তামাকে সহজেই বাঁকানো যায়। কিন্তু বিশেষ উপায় বের করে ফেলেছিল মিসরীয়রা।

তামার সঙ্গে তারা ভেজাল হিসেবে ব্যবহার করত আর্সেনিক। সেগুলো ব্যবহার করেই পাথর কাটার ব্যবস্থা করেছিলেন মিসরের প্রাচীনকালের শ্রমিকেরা। ব্রিটিশ প্রকৌশলী ও মিসরতত্ত্ববিদ ডেনিস স্ট্রোকস এক ডকুফিল্মে জানিয়েছেন সে কথা।
এসব ছেনি দিয়ে চুনাপাথর কাটা যেত সহজেই। কিন্তু গিজার ছোট পিরামিডের ভেতরে পাওয়া গেছে বড় বড় সব গ্রানাইট পাথরের চাই। গ্রানাইট হলো হীরার পর পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বস্তু। সুতরাং তামা- আর্সেনিকের সংকর ধাতু দিয়ে এ পাথর কাটা অসম্ভব। এসব পাথর কেটে ব্লক তৈরি করতে হলে দরকার করাতের মতো বড় কিছু। সেটাও বানাতে শিখেছিল মিসরীয়রা। তারা লম্বা তামার পাতের (আর্সেনিক মিশ্রিত) একটা প্রান্ত ঘষে ব্লেডের মতো ধারালো করে নিত। করাতের মতো দাঁতালো নয় এমন ধাতব ব্লেড। কারণ, দাঁতালো করাতের পক্ষে গ্রানাইট কাটা সম্ভব নয়। ধাতব ব্লেডের দুই মাথায় দড়ি বেঁধে দুই দিক থেকে দুজন টানত করাতের মতো করে। একটা ব্লক তৈরি করতে প্রায় সময় লাড়ত সাত মাস। এ জন্যই পিরামিড তৈরিতে এত সময় লেগেছে।


ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাপজোখটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য তারা কাজে লাগিয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যা। আকাশের তারাদের নিয়ে তাদের উৎসাহ ছিল। করত মহাকাশচর্চাও। দিক ঠিক করত তারা দেখে। গ্রেট পিরামিড তৈরিতেও তারা নক্ষত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন বলে মনে করেন মিসরতত্ত্ববিদেরা। তারাদের সাহায্যে পাই টু পাই দিক মিলিয়ে চারটি হেলানো তল চারদিকে বসাতে সফল হয় মিসরীয়রা।

গিজার গ্রেট পিরামিড কিন্তু শুধুই একটা পিরামিড নয়। এখন তিনটি বড় পিরামিড আছে, তার পাশেই তিনটি ছোট পিরামিড। বড় পিরামিড তিনটি একই সরলরেখায় থাকলে ব্যাপারটা সুন্দর হতো। কিন্তু এদের দুটি একই সারিতে হলেও একটার অবস্থান একটু এক পাশে। কেন? এ প্রশ্ন বহুদিনের। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করেন বেলজিয়ান মিসরতত্ত্ববিদ রবার্ট বাউভাল। তিনি যুক্তি দেন, আকাশের অরিয়ন নক্ষত্রমণ্ডলের প্রধান তিনটি তারা আলনিটাক, আলনিলাম আর মিলনামা। মিসরে রাতে যখন এ তারাগুলো দেখা যায়, তখন তিনটি বড় পিরামিডের চূড়া বিন্দুর ওপর এ তিনটি তারার অবস্থান পুরোপুরি মিলে যায়। তিনটি পিরামিড একই সরলরেখায় হলে এভাবে তারাদের অবস্থানের সঙ্গে মিলত না। সম্ভবত এ তিন তারার কথাই ভেবেই খুফু পিরামিড তিনটির অবস্থান এভাবে সাজিয়েছিলেন।

পিরামিড তৈরিতে আরেকটা ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেটা হলো লেভেলিং। পুরো ভিতের জায়গাটা পাই টু পাই সমতল না হলে এত বড় স্থাপনা সম্ভব নয়। এ জন্য পিরামিডের চারপাশে পরিখা খনন করা হয়। তাতে পানি ঢেলে দেখা হয়, এক পাশ থেকে অন্য পাশে গড়িয়ে যায় কি না। যেদিকে পানি গড়াবে, সেদিকটা নিচু। উল্টো দিকের মাটি কেটে আবার লেভেলিং করা হতো। একটা ত্রিভুজাকৃতির কাঠের শীর্ষবিন্দুতে দড়ি ঝুলিয়ে, তাতে একটা ছোট্ট ভারী বস্তু ঝুলিয়েও লেভেলিং করা হতো বলে মনে করেন ডেনি স্টোকস।

বিজ্ঞান প্রমাণে বিশ্বাসী। কিন্তু চাইলেই যেকোনো প্রশ্নের দ্রুত সমাধান পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিনের গবেষণা আর ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণের মাধ্যমেই একসময়কার অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে। অনেকেই এ সময়টুকু দিতে নারাজ।

পিরামিড নিয়েও বহু গুজব ছিল বাজারে। এখনো আছে। অনেকে এর পেছনে এলিয়েনের কারসাজি খুঁজেছেন। কিন্তু গুজবে কান না দিয়ে বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান করলেই আসল ইতিহাস জানা সম্ভব।