মহানবী (সা.)-এর পরিবারের নারী সদস্যদের বিশেষ মর্যাদা

9
মহানবী (সা.)-এর পরিবারের নারী সদস্যদের বিশেষ মর্যাদা

মহানবী (সা.)-এর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন তাঁর জীবনচরিতের সর্বোত্তম ভাষ্যকার। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনযাত্রায় তাঁরাই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী, তাঁর সুখ-দুঃখের সবচেয়ে বড় অংশীদার, বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে নবী পরিবারের নারীদের অবদান অবিস্মরণীয়। কেননা তাঁদের মাধ্যমেই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে ইসলামের প্রায়োগিক রূপরেখা উম্মাহর সামনে প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামের অন্য বিষয়গুলোও তাঁদের বক্তব্যের সংযোগে পূর্ণতা লাভ করেছে।

নবী পরিবারের বিশেষ মর্যাদা

Pop Ads

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারের মর্যাদা কোরআনের একাধিক আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৩)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা বলল, আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময় বোধ করছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি আছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি প্রশংসিত ও সম্মানিত।

’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৭৩)
নবী পরিবারে নারীর মর্যাদা

পরিবারে নারীদের প্রতি নবীজি (সা.) অত্যন্ত স্নেহশীল এবং তাঁদের অধিকার রক্ষায় সচেতন ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পার্থিব বস্তুর মধ্যে স্ত্রী ও সুগন্ধি আমার কাছে পছন্দনীয় করা হয়েছে এবং নামাজে রাখা হয়েছে আমার চোখের প্রশান্তি। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩৯৩৯)

কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে নবীজি (সা.) বলেন, প্রকৃতপক্ষে ফাতিমা আমারই অংশ, যা তাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকেও কষ্ট দেয়, যা তাকে ক্লান্ত করে তা আমাকেও ক্লান্ত করে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৬৯)

যাঁরা যেভাবে অবদান রেখেছেন

সার্বিক বিবেচনায় নবী পরিবারের নারীদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

তা হলো— ১. যাঁরা নবীজি (সা.)-এর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন, ২. যাঁরা নবীজি (সা.)-এর পরও জীবিত ছিলেন। প্রথম শ্রেণি মহানবী (সা.)-এর সেবা, ইসলামের জন্য কষ্ট স্বীকার ও আত্মত্যাগ বেশি করেছিলেন। আর দ্বিতীয় শ্রেণি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রাপ্ত ইসলামের শিক্ষা ও নবীজি (সা.)-এর বাণী মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেন।

নবী পরিবারের নারীদের আত্মত্যাগ

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় নবী পরিবারের নারীদের ভেতর যাঁরা ইন্তেকাল করেন, তাঁদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হলেন খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ও নবীজি (সা.)-এর তিন কন্যা। এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ (রা.)-ও প্রণিধানযোগ্য।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের কয়েক মাস পর ফাতেমা (রা.)-ও ইন্তেকাল করেন।
মক্কার কঠিন জীবনে তাঁরা সবাই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর ছায়াসঙ্গী। নবীজি (সা.)-এর মতো তাঁরা মক্কার মুশরিকদের অত্যাচার সহ্য করেন, বিশেষত শিআবে আবি তালিবের অবরুদ্ধ দিনগুলোতে অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেন তাঁরা। খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ছাড়া অন্যরা ইসলামের জন্য মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদিনায় চলেন আসেন। হিজরতের আগেই খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকাল হয়।

নবীজির চাচি ফাতেমা : দাদা আবদুল মুত্তালিবের ইন্তেকালের পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন। আবু তালিবের স্ত্রী ফাতেমা বিনতে আসাদ (রা.) নবীজি (সা.)-কে সন্তানের মতোই গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর নবীজি (সা.) তাঁর অবদান স্মরণ করে বলেন, হে মা! আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন। মায়ের পর আপনিই ছিলেন আমার মা। আপনি ক্ষুধার্ত থেকে আমাকে তৃপ্ত করেছেন, আপনি ছিন্ন কাপড় পরিধান করে আমাকে পোশাক পরিয়েছেন, আপনি নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করেছেন এবং আমার জন্য তা প্রত্যাশা করেছেন। আপনি এসব করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তির আশায়। (সুনানে তাবারানি : ২৪/৩৫১)

স্ত্রী খাদিজার আত্মত্যাগ : খাদিজাতুল কুবরা (রা.) স্ত্রীদের মধ্যে নবীজি (সা.)-এর জন্য সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ স্বীকার করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে তিনি ছিলেন আরবের ধনাঢ্য নারীদের একজন। বিয়ের পর নিজের সমুদয় অর্থ-সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য ব্যয় করেন। নবুয়ত লাভের আগে নবীজি (সা.) যখন নিঃসঙ্গ প্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তিনি গারে হেরায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন, তখন খাদিজা (রা.) নিয়মিত খাবার নিয়ে সেখানে হাজির হতেন। প্রথম ওহি আসার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ভয় পেলে তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, আল্লাহর কসম, কখনই নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানকে আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদিজা (রা.)-এর ত্যাগের স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে তাঁর চেয়ে উত্তম কাউকে দেননি। কেননা যখন মানুষ আমার সঙ্গে কুফরি করেছিল তখন খাদিজা আমার ওপর ঈমান এনেছিল, যখন মানুষ আমাকে অবিশ্বাস করেছিল তখন সে আমাকে সত্যায়ন করেছিল, যখন মানুষ আমাকে বঞ্চিত করেছিল তখন সে আমাকে তার সম্পদে অংশীদার করেছিল, তার গর্ভ থেকে আল্লাহ আমাকে সন্তান দান করেছেন অন্য কোনো স্ত্রীর গর্ভ থেকে আমাকে কোনো সন্তান দেওয়া হয়নি। (মুসনানে আহমদ, হাদিস ২৪৮৬৪)

ইসলাম গ্রহণের পর দুই মেয়ের আত্মত্যাগ : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যারাও এই আত্মত্যাগের অংশীদার। তাঁরা ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অগ্রগামী। বয়সে নবীন হলেও তাঁরা ইসলামের জন্য ত্যাগ স্বীকারে কখনো পিছপা হননি। ঐতিহাসিকরা লেখেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কাবাসীকে ঈমানের আহ্বান জানালে আবু লাহাব ও তার পবিবার উত্পীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আবু লাহাবের নিন্দায় সুরা লাহাব অবতীর্ণ হলে তার দুই ছেলে উতবা ও উতাইবা পিতার নির্দেশে মহানবী (সা.)-এর দুই কন্যা রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুমকে তালাক দেয়। অবশ্য তখনো তাঁদের উঠিয়ে দেওয়া হয়নি, কেবল আকদ হয়েছিল। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/২৯৭)

বিপদের মুহূর্তে ফাতেমার সহযোগিতা : একদিন মহানবী (সা.) মসজিদুল হারামে সিজদারত অবস্থায় ছিলেন। তখন উকবা ইবনে আবি মুয়িত আল্লাহর রাসুলের মাথার ওপর মরা উটের নাড়ি-ভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়। ফলে তিনি উঠতে পারছিলেন না। ফাতিমা (রা.) দৌঁড়ে এসে তাঁর ওপর থেকে নাড়ি-ভুঁড়ি সরিয়ে দেন। ভারমুক্ত হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই পাষণ্ডসহ আরো কয়েকজনের নাম ধরে বদদোয়া করেন। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-১০৪)

আল্লাহ মুহাম্মদ (সা.), তাঁর পরিবার, সাহাবি ও কিয়ামত পর্যন্ত আসা তাঁর সব অনুসারীর প্রতি শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। আমিন।