রাতে আকাশ কালো কেন?

12
রাতে আকাশ কালো কেন?

বিজ্ঞানীরা সবসময় উদ্ভট প্রশ্ন করতে ভালোবাসেন। আর এসব উদ্ভট প্রশ্ন থেকে তাঁরা প্রকৃতির রহস্যভেদ করতে চান। আপেল গাছের নিচে বসে নিউটনের মনে হয়েছিল, আপেলটি গাছ থেকে নিচে পড়লো কেন? এই প্রশ্নটি নিউটনের আগে কারো মাথায় আসেনি। সবাই ভেবেছে আপেলতো নিচেই পড়বে।

কিন্তু নিউটন সেভাবে ভাবেননি। তিনি ভেবেছিলেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আপেলটিকে নিচের দিকে টানছে। তারপর তিনি আবিষ্কার করলেন সব বস্তুই পরস্পরকে আকর্ষণ করছে।

Pop Ads

যে বস্তুর ভর যত বেশি তার আকর্ষণের ক্ষমতাও তত বেশি। আমাদের পায়ের নিচের পৃথিবীটা যেহেতু বিশাল বড়ো, তাই তার আকর্ষণের ক্ষমতাও খুবই বেশি। সেটাকে উপেক্ষা করা ক্ষুদ্র আপেলের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই বেচারাকে মাটিতেই পড়তে হয়েছে। নিউটন সেটার নাম দিয়েছিলেন, গ্রাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ।

এভাবেই সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে অনেক বড় বড় আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে একজন জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী, নাম তাঁর হেনরিক ভিলহেম ওলবার্স, একটি উদ্ভট প্রশ্ন করেছিলেন, রাতের আকাশ কালো কেন?
সাধারণ মানুষ বলবে, এ তো সহজ প্রশ্ন, রাতের আকাশে সূর্য থাকে না, তাই রাতের আকাশ অন্ধকার দেখায়। কিন্তু আগেই বলেছি, বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির রহস্য ভেদ করতে চান। সাধারণের দৃষ্টি যেখানে শেষ হয়ে যায়, বিজ্ঞানীরা সেখান থেকেই তাঁদের দেখা শুরু করেন। ওলবার্স বললেন, ঠিক আছে, বুঝলাম রাতে সূর্য থাকেনা, কিন্তু অসংখ্য নক্ষত্র তো থাকে।

এরা একেকটি সূর্যের মতোই গনগনে আগুনের পিণ্ড, আলোর উৎস। যদিও তাদের অবস্থান অনেক দূরে, কিন্তু কোটি কোটি নক্ষত্রের সম্মিলিত আলোর ছটায় রাতের আকাশ তো আলোকিত হয়ে উঠার কথা, কিন্তু সেটি হচ্ছে না কেন?
জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই প্রশ্নটিকে বলা হয়, ওলবার্স প্যারাডক্স। বিজ্ঞানীরা গত দুইশ বছরে নানা ভাবে এই প্রশ্নটির উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন, মহাশূন্যে প্রচুর ধূলিকণা আছে, সেজন্য বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে আসা আলোকরশ্মি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটা অনেক বিজ্ঞানী মানলেন না। তাঁরা বললেন, তাহলে ধূলিকণাগুলো উজ্জ্বল হয়ে নিজেরাই আলো বিকিরণ করতো, কিন্তু সেটি তো হচ্ছে না।

আরেক দল বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা দিলেন অন্যভাবে। তাঁরা বললেন, দ্রুত অপসৃয়মান নক্ষত্রগুলোর রেডশিফটের (ৎবফ ংযরভঃ) কারণে দৃশ্যমান আলো অদৃশ্য ইনফ্রারেড আলোতে পরিণত হচ্ছে। সেজন্য সেগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। অন্যরা বললেন, তাহলে তো একই প্রক্রিয়াতে আলট্রা ভায়োলেট আলোও দৃশ্যমান আলোতে রূপান্তরিত হতো, সেটিও তো হচ্ছেনা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ওলবার্স প্যারাডক্সের কোনো সুরাহা হলো না।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে যখন বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব আবিষ্কৃত হলো তখন বিজ্ঞানীরা এই ধাঁধাটির একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর পেলেন। তাঁরা বললেন, মহাবিশ্বকে কার্যত অসীম মনে হলেও আসলে মহাবিশ্বের একটি সীমারেখা রয়েছে। তার কারণ হলো মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়েছিলো। তারপর থেকে মহাবিশ্ব ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। তাঁদের ধারণা এই বিস্ফোরণটি ঘটেছিলোও এখন থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে।

সুতরাং সর্বোচ্চ ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে পৃথিবীতে আলো আসা সম্ভব। মহাবিশ্বের সকল নক্ষত্রের আলো হয়তো এখনো এসে পৌঁছেনি আমাদের পৃথিবীতে।

দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানীরা দেখলেন নক্ষত্রগুলোর একটি নির্দিষ্ট জীবনকাল রয়েছে। কোন নক্ষত্র অনন্তকাল ধরে প্রজ্বল্ল্যমান থাকে না। তাদের জ্বালানি একসময় ফুরিয়ে যায়। তার মানে হলো যে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক নক্ষত্রের আলোই এসে পৃথিবীতে পৌঁছায়। নক্ষত্রের এই সংখ্যাটি সীমিত। রাতের কালো আকাশকে উজ্জ্বল করতে এই সংখ্যাটি যথেষ্ট নয়। এটাই হচ্ছে ওলবার্স প্যারাডক্সের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা।